শুক্রবার, ৩ জুন, ২০১৬

জগাদাদা

আমাদের বাড়িতে কাজ করত জগাদাদা। ঊড়িষ্যার লোক। কিশোর বয়সে কাজ করতে এসেছিল কলকাতায়। সে আমার জন্মের ঢের আগে। তখন বাড়িভর্তি লোক। শুনেছি জগাদাদা নাকি আমাদের বাড়িতেই চুরি করে ধরা পড়ে যায়। চাকরি গেছিল কিনা জানিনা, কিন্তু যোগাযোগ যায়নি। "পুরাতন ভৃত্য" ট্র্যাডিশন। পরে বাবা কোথায় কী কলকাঠি নেড়ে সরকারী অফিসে পিওনের চাকরি করে দেয় জগাদাদার।

তারপর থেকে মাঝে মাঝে, দু-চার মাস অন্তর, রোববার করে চলে আসত বেলা দশটা-এগারোটা নাগাদ। কাজ-টাজ কিছু করে দিত। পাখা পরিস্কার করবে? দাঁড়া, জগা আসুক। কুলুঙ্গি থেকে জিনিস পাড়তে হবে? দাঁড়া জগাকে খবর দিই। এরকম সব ব্যাপার। ধুতি কোঁচান তো দেখেছি জগাদাদা ছাড়া হতই না। আর জগাকে দেখলে আমার বাবার গা-টেপানো পেয়ে যেত। সারাদিন থাকত জগাদাদা। কাজকর্ম করে দিত, খাওয়া-দাওয়া করত। গল্পগুজব করত, মূলতঃ ওম্মার সঙ্গে। তারপরে সন্ধ্যে-রাত্তিরের দিকে চলে যেত। বাড়িতে কারুর বিয়ে-টিয়ে হলে দুদিন আগে জগাদাদা চলে আসত আর একা হাতে বহুদিক সামলাত। যগ্যিবাড়ির বাজার হবে কলেজ স্ট্রীট থেকে - জগাদাদা। গায়ে হলুদের মাছ আনতে হবে - জগাদাদা। বিয়ের ফুল - জগাদাদা। তার ওপর বিয়েতে নাপিতের কাজও করে দিত জগাদাদা। একদম গ্র্যাটিস। দাদা আর দিদির বিয়ে অব্দি দেখেছি এই চলেছে। আর ওইসময়ে বার-দুত্তিন এরকম হয়েছে যে আমরা বাড়ি ফাঁকা করে সদলবলে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি, জগাদাদা এসে বাড়িতে থেকে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। চুরির একটা ইতিহাস থাকায় মা-র মনে খুঁতখুঁতুনি দেখেছি, কিন্তু আবার ভরসা করে ছেড়ে যেতেও দেখেছি। 

জগাদাদার এক না দুই ছেলে ছিল। মাঝেমাঝে এসে বলত ছেলে অমুক ক্লাস। একদিন বলল ছেলে মাধ্যমিক পাশ করেছে, উচ্চ মাধ্যমিকও পাশ করল। ছেলের চাকরি পাওয়ার কথাও যেন শুনেছিলাম। আমি ৯৩ সালে দেশ ছাড়ি। নব্বইয়ের দশক থেকেই জগাগদাদার আসা কমে যেতে থাকে। বয়েসও হচ্ছিল। ১৯৯৭-তে ওম্মা মারা যাবার পরে সে আসা আরও কমে যায়। শুনেছিলাম রিটায়ার করে জগাদাদা ঊড়িষ্যায় নিজের ভিটেতে ফিরে গেছে।

এখন তো কেউ চাকর-ঝি রাখে না। বাড়িতে কাজের লোক বা কাজের মাসী কাজ করে। কিন্তু তাদের সঙ্গে এই দীর্ঘ ওঠা-পড়ার সম্পর্ক কি তৈরি হয়? কে জানে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন