সোমবার, ১৩ জুন, ২০১৬

নাট্যারম্ভ

আমি বহু বছর বিদেশে নাটক করেছি, বুঝলেন। বেশ সিরিয়াসলি। খাটাখাটনি করেছি। কয়েকবার তো নিজেরা লিখে - একবার প্রায় ওয়ার্কশপের মতন করে। তার সঙ্গে প্রতিবারই নিজেরা সেট ডিজাইন করেছি, বানিয়েছি; লাইট ডিজাইন করেছি; মিউজিক বানিয়েছি-বাজিয়েছি-রেকর্ড করেছি ইত্যাদি। সঙ্গে তো অভিনয়, পরিচালনা ইত্যাদি আছেই। আর আছে মার্কেটিং, টিকিট বিক্কিরির বিভীষিকা। সে এক, যাকে বলে, বিশাল কর্মযজ্ঞ। এর সবই একেবারে শূন্য থেকে শিখতে হয়েছে। আমাদের মধ্যে এর আগে সিরিয়াস নাট্যচর্চা করেছিল একমাত্র অমিতাভ (Amitava Baksy), আর কিছুটা বোধহয় ইন্দ্রাণী। কিন্তু-কিন্তু করে এও বলি যে প্রোডাকশন কোয়ালিটিও একেবারে দুচ্ছাই কিছু হতনা, কিছু ক্যাপটিভ অডিয়েন্সও তৈরি হয়েছিল। এসবই হয়েছে কিছু সমমনস্ক, নাটুকে আর খাটতে-ও-শিখতে-ইচ্ছুক নারী-পুরুষ এক সময়ে এক জায়গায় জড় হয়েছিলাম বলে।

কিন্তু আমার নাটকের জীবন দীর্ঘতর, সেটা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। এই সুদূরপ্রসারী নাট্যজীবন শুরু হয়েছিল নামভূমিকায় অভিনয় দিয়ে। "গাধা-পিটিয়ে-মানুষ" নাটকে গাধা, "কালো কুকুর" নাটকে কুকুর - নটসূর্য হবার দিকে এই ছিল যাত্রারম্ভ।
 
এর বহু পরে, কলেজে পড়াকালীন পাকামি ও আঁতলামির বিছে যখন কামড়াল তখন কয়েকজন বন্ধু মিলে দল গড়ে নাটক করতে শুরু করলাম। একজনেরও পুজোর নাটকের বাইরে নাটক করার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। তাতে কি ডরাই কভু ভিখারী রাঘবে? বাংলায় কেউ নাটক লিখতে পারে? ধুর ধুর। আমরা দেখিয়ে দেব। মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। একেবারে ইবসেন। Ghosts. অনুবাদ আছে না? আছে, কিন্তু ছ্যা ছ্যা, অন্যের অনুবাদ নিবি কি রে! নিজেরা আনুবাদ কর। অভিজ্ঞতা তো নেইই, কনফিডেন্সও নেই। তাই তিনবন্ধু একেক জন একেকটা অঙ্ক অনুবাদ করলাম। বাংলা সাহিত্যকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে সে অনুবাদ বা অনুবাদগুচ্ছ কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে যদিও। বাঁচা গেছে। নইলে যে কী হত, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। দলের কারুর নাটকের অভিজ্ঞতা ছিলনা বলে যে লিখেছি, সেটা ঠিক লিখিনি। টুকটুকির ছিল। দলের দুজনের মধ্যে অন্যতম মহিলা সদস্য। টুকটুকি অসম্ভব ভাল আবৃত্তিও করত, আজকাল যাকে বাচিক শিল্প বলে।

সে নাটক একেবারে টপ-টু-বটম ডিজাস্টার। দলের নাম নৈর্ব্যক্তিক। আর্দ্ধেক লোক উচ্চারণই করতে পারল না। নাটকের নাম আবর্ত। আমার কাকা বলেছিল, পাকামি কোরোনা। স্পিন বল দেবার আগে সোজা বল দিতে শেখ। কে শোনে কার কথা! নাটকের আগে শ্যমাবাজারে গিয়ে মেকাপ আর সেটের বরাত দিয়ে এলাম। "জমিদার বাড়ির সেট তো? হয়ে যাবে।" লাইটের বরাত পেল সল্ট লেকের বৈশাখীর একজন। পাড়ার পুজোর নাটকে লাইট করেছিল। মানে দুদিকে দুটো লাইটের সামনে মুড অনুযায়ী লাল-নীল কাগজ-ধরা। তাৎক্ষণিক। স্ক্রিপ্ট-টিপ্ট পড়ার কোন গল্প নেই। নাটকের দিন মেকাপ আর লাইট এল। সেট আর এল না। লাইটের লোক বলল, "জমিদার বাড়ির সেট করে দেব"? তাই সই। লোকের হাতে-পায়ে ধরে টিকিট বেচা হয়েছে। টিকিট তো নয়, গেস্ট কার্ড। কারণ টিকিট হলে এন্টারটেনমেন্ট ট্যাক্স না কী একটা দিতে হবে। সে ট্যাক্স মকুব করা মহা ঝামেলা। তো নাটক শুরু হবে সাতটায়। লোকজন গুটিগুটি আসতে শুরু করেছে। সাড়ে ছ'টা নাগাদ লোডশেডিং হয়ে গেল। কুছ পরোয়া নেহি। হলে জেনেরেটর আছে। চালাও জেনেরেটর। কিন্তু জেনেরেটরের লোক গলদঘর্ম হয়ে গেল। জেনেরেটর আর চালু হয়না। ম্যানেজার এসে পড়লেন। সরকারী কর্মচারী। নাটকের একটি মূল চরিত্র তাকে চমকাতে গিয়ে পুলিশের হুমকি খেল। সে একে কেলেংকারিয়াস প্যান্ডেমোনিয়াম। শেষ অব্দি আলো এসে নাটক শুরু হল বোধহয় রাত ন'টা নাগাদ। ততক্ষণে ষাট শতাংশ দর্শক - মানে যারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিংবা আত্মীয় নয়, তারা পাতলা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস। কারণ সে যা নাটক হয়েছিল!

এরপরেই বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে দলটির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। তবে সত্যের খাতিরে এও বলে রাখা ভাল আমরা আরও একটি নাটকের মহড়া শুরু করেছিলাম। সে নাটক আর মঞ্চস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। নাটক ও নাট্যকার খুব বেঁচে গেছেন। আমরা তথৈবচ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন