শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

মোটা

আমি ডাকি মোটা বলে। স্কুলে ছ'বছর, আর তারপরে কলেজে চারবছর একসঙ্গে পড়েছি। তাছাড়া মোটারা থাকতও সল্ট লেকে খুবই কাছে। আমরা সিডি ব্লক, মোটারা এবি ব্লক। কোণাকুণি দেখলে মাঝখানে একটা মাত্র ব্লকের ব্যবধান - বিসি। এই নৈকট্য পরে খুব সুবিধে দিয়েছে।

মোটার মতন বন্ধুবৎসল ছেলে খুব কম দেখেছি। বন্ধুবৎসল এবং অসূয়াহীন। কম নয়, দেখিইনি। কলেজে অন্যরা ক্লাস করছে না। এমনিই করছে না। মোটাকে ক্লাস করার জন্যে তারা ব্যাগড়াও দিয়েছে। তাও মোটা ক্লাস করে যে শুধু নোট নিচ্ছে তাইই নয়, এক্সট্রা দুটো কার্বন কপিও নিচ্ছে। কোন বন্ধুর কখন কাজে লেগে যায়, কে জানে!
বাড়ি ফেরার মুখে মোটা বলল, "দশ টাকা দে।" দিয়ে দিলাম। পরের দিন মোটা কটা খুচরো পয়সা আর একগাদা জেরক্স-করা পাতা দিল। স্যার কোন বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছেন। মোটা নিজের জন্যে কপি করছিল, অন্যরা বঞ্চিত হবে কেন? তাই নিজে উপযাচক হয়ে সবাইকার জন্যে জেরক্স করে দিয়েছে। অনেকবার।

মোটার দোষ বলতে, মোটা ক্লাস করতে খুব ভালবাসত। শুধু ক্লাস করতেই নয়, মোটা পড়াশুনো করতেই ভালবাসত। কলেজে, ক্লাসে মোটামুটি সবাই রাজী হয়েছে মাস কাট দিতে, কিন্তু বেঁকে বসল মোটা আর রাজা। এরকম বহুবার হয়েছে যে ক্লাসে শুধু মোটা, রাজা আর প্রফেসর। ক্লাসের বাকিরা ভিতর হতে বাহির হয়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল বাহিরে গাছতলায় বসে কালাতিপাত করছে। পরে এই আমরাই ক্লাস টেস্টের আগের রাতে বা এমনকি সেমেস্টার পরীক্ষার আগের রাতে মোটার বাড়িতে হানা দিয়েছি। মোটা নিজের নোট দিয়ে দিয়েছে ব্যাকবেঞ্চারগুলোকে। আমার লাইব্রেরি কার্ড তো চারটি বছর মোটার কাছেই গচ্ছিত ছিল। মোটাই আমার জন্যে বই তুলত, আমাকে পড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করত, আবার ফেরত দিয়ে দিত।

পরে ভেবে মনে হয়েছে মোটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া উচিত হয়নি। বাবার মতন পলিটিকাল সায়েন্স বা অন্য কোন সোশ্যাল সায়েন্স পড়া ভাল হত। তবে সে তো এখন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করে প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউটে পড়াচ্ছে আর হিল্লি-দিল্লি-বিলেত করে বেড়াচ্ছে। খান চারেক বইও প্রকাশ করে ফেলেছে।

মোটার যে গল্পটা ফোকলোর হয়ে গেছে, সেটা বলি। ইশকুলের গল্প। ক্লাস ইলেভেন। মোটার গায়ে অমানুষিক শক্তি ছিল। কিন্তু মুশকিল হল মোটা সেটা জানত না। এর ফলে অনেক ছেলে অকারণে আহত-টাহত হয়েছে। সে যাক। ইলেভেনে, ক্লাসে সাত রো বেঞ্চির দ্বিতীয় সারিতে মোটা বসত। একবার টিফিনের পরে মোটার প্যান্টের বেল্টের লুপে একটা মোটা নারকোল দড়ি দিয়ে ল্যাজ করে দেওয়া হল। মোটা টের পায়নি। ল্যাজটা লম্বা। খুব লম্বা। এত লম্বা যে তার অন্য দিকটা শেষ, মানে সাত নম্বর, সারিতে বেঞ্চির পায়ায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। একদম মোরম্বা করে। আর সেই বেঞ্চিতে গাদাগাদি করে ছ'টা উঠতি জোয়ান ছেলে বসে ক্লাস করছে। বেঞ্চি নড়ে যাবার কোন সিনই নেই। এরপর বিজয়াদি ক্লাসে এসেছেন। এসে মোটাকে কিছু একটা জিগেস করেছেন। মোটা ক্লাসে জবাব-টবাব দিতে খুব ভালবাসত। তো জবাব দেবে বলে উৎসাহভরে উঠতে গিয়ে মোটা ল্যাজে ঠেকে গেল। উঠতে পারল না। তখনও বুঝতে পারেনি কিসে আটকাচ্ছে। আবার ওঠার চেষ্টা করল। আবার আটকাল। তিন নম্বর বারের বার সর্বশক্তি দিয়ে মোটা উঠে দাঁড়া্তেই পেছনের বেঞ্চির পায়াটি মোটার শক্তির কাছে পরাভূত হয়ে নিজের কাজে ইস্তফা দিল এবং ছ'টি সা-জোয়ান ছেলে ভূমি নিল। এ জিনিস চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

মোটা, শুনছিস?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন