রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৪

সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মন - দ্বিতীয় পর্ব


সলিল বা রাহুল কেউই খুব কড়া রাগভিত্তিক গান বানাতে পছন্দ করতেন বলে মনে হয়না । তবে যেহেতু দুজনেই মূলতঃ ছবির জন্যে গান বানাতেন, বিভিন্ন সিচুয়েশনে রাগনির্ভর গান বানাতে হয়েছে । এর বাইরে বেসিক গানে দুজনেই রাগ ব্যবহার করেছেন খুবই নিয়ন্ত্রিতভাবে, এবং প্রায় সব সময়েই রাগরূপকে প্রকট না করে ।

রাগ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সলিল কিন্তু রাগের চলন বা পকড় প্রতিষ্ঠা করে দিতেন প্রথমেই। রাহুল আনতেন এক দু লাইন পরে। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। এমনকি এমনও বলতে পারি যে ব্যতিক্রমের সংখ্যা এত বেশি যে আগের মন্তব্য হয়ত করা ঠিকই নয়। তবু সেই মন্তব্যের স্বপক্ষে কয়েকটা উদাহরণ দিই।

কলাবতী রাগকে ভিত্তি করে সলিল চৌধুরীর বেশ গুটিকয়েক গান আছে । এর মধ্যে ধরা যাক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলায় "ঝনন ঝনন বাজে" গানটি । পঞ্চাশের দ্শকে তৈরি গান। প্রথম লাইনেই কলাবতী পরিষ্কার। অন্তরাতে গিয়ে গানের চলন বদলে যাচ্ছে।

ঝনন ঝনন -

আরেকটা কলাবতীভিত্তিক গান, "লাল পাথর" ছবিতে সবিতা চৌধুরী আর শ্যামল মিত্রর যৌথ - "ডেকোনা মোরে ডেকোনা গো আর"। এখানেও প্রথম লাইন থেকেই রাগ চিনতে অসুবিধে হয়না।

ডেকোনা মোরে -



অথচ এই কলাবতী (বা মিশ্র কলাবতী) রাগে রাহুলের গান - "বল কী আছে গো" নিজের গলায়, যার হিন্দি গেয়েছিলেন মান্না দে ও লতা মঙ্গেসকর জুরমানা ছবিতে, "এ সখী, রাখিকে"। কলাবতীর চলন প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু, গানের আভোগে নয়, অন্তরায় গিয়ে - "চকিত চাহনী যেন দেখেও না দেখা"। আভোগ বা মুখড়ার দু-লাইনে রাহুল রাগকে আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রাখেন।

বল কী আছে গো -

এ সখী -


এরকম আরেকটা উদাহরণ শিবরঞ্জনী রাগে। সলিল করলেন "ধরণীর পথে পথে আমিও পৌঁছে যাব"। গাইলেন একবার সুবীর সেন, একবার লতা মঙ্গেশকর। প্রথম থেকে শিবরঞ্জনী প্রতিষ্ঠিত। এবং সলিলের যা রীতি, অন্তরাতে গিয়ে রাগ গৌণ, সলিলের সুর মুখ্য হয়ে পড়ল।

ধরণীর পথে পথে - সুবীর সেন


রাহুল মিশ্র শিবরঞ্জনীতে করলেন "মেরে নয়না সাওন ভাদো" - মেহেবুবা ছবির জন্যে কিশোরকুমার আর লতা মঙ্গেশকর আলাদা দুটি গান গাইলেন। এখানে পকড়ের ছবি পাওয়া যাচ্ছে, পাশ্চাত্য রক-পপে যাকে গানের হুক বলে সেই অংশে, দ্বিতীয় "ফির ভি মেরা মন পেয়াসা" উচ্চারণে। গানের প্রথমেই নয়।

মেরে নয়না - কিশোরকুমার


এবার উল্টোদিকে - শেষ জীবনে (১৯৯০ সালে) করা গান, নন্দ বা আনন্দী কল্যাণ  রাগে হৈমন্তী শুক্লা গাইলেন, "মন বন পাখী চন্দনা"। প্রথম লাইনের নন্দবাবুকে চিনে নেওয়া গেল।



রাহুল মিশ্র নন্দ রাগে করলেন "যেতে দাও আমায় ডেকোনা"। এখানে বরং প্রথম লাইনে নন্দবাবুকে ধরা যায় কিছুটা।

যেতে দাও আমায় -



সলিল চৌধুরী করলেন অন্তরা চৌধুরীর জন্যে বেহাগ-আশ্রিত "না দির দির দা, তুম না তুম, নাচ তো দেখি আমার পুতুলসোনা", প্রথম লাইন থেকে বেহাগ খুলে পড়া যায়।

না দির দির দা -


যেমন যায় প্রায় একই সময়ে করা - সত্তরের দশকের প্রথম দিকে - "আপ কি কসম" ছবির জন্যে রাহুলের সুরে কিশোরকুমারের "জিন্দেগীকে সফর মেঁ গুজর যাতে হ্যায়" গানে।

জিন্দগীকে সফর মেঁ -


আগেই যে বললাম, খুব কড়া রাগভিত্তিক গান তৈরি করতে কি সলিল, কি রাহুল, কেউই পছন্দ করতেন না। কিন্তু ছবির সিচুয়েশন অনেক সময়ই রাগভিত্তিক গানে চেয়েছে। সেরকম ক্ষেত্রে এনারা রাগের পরিসীমার মধ্যে থেকেই যতটা সম্ভব নিজেদের সাঙ্গীতিক উদ্ভাবনী দেখিয়েছেন। এমনই একটি গান - সলিলের বিখ্যাত হংসধ্বনী, "যা তোসে নহি বলুঁ কানহাইয়া"। একদম রাগদারী গান, প্রথম লাইন থেকেই।



এ গানেরই বাংলা করলেন শেষ জীবনে, গাওয়ালেন হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে -


রাহুল এমতাবস্থায় বহুবার বাবার খজানায় হাত বাড়িয়েছেন - যেমন কিনারা ছবিতে "মিঠে বোলে বোলে" শচীনের বিখ্যাত বাংলা ভৈরবী "মধুবৃন্দাবনে দোলে রাধা"-কে ফিরিয়ে আনে।

মিঠে বোলে বোলে -


মধুবৃন্দাবনে -


অথবা ইজাজত ছবির "খালি হাত শাম আয়ি হ্যায়" গানে ফিরিয়ে আনলেন কর্তার "মালাখানি ছিল হাতে" গানের বন্দিশ।

খালি হাত -


মালাখানি -


অথচ এমনটা নয় যে বাবার খজানা ছাড়া এই ধরণের সিচুয়েশনে রাহুলের কোনরকম অসুবিধে হত। অমর প্রেম ছবিতে "রহনা বীত যায়" কি "কুছ তো লোগ কহেঙ্গে" অথবা "বড়া নটখট হ্যায় ইয়ে" গানেই তার প্রমাণ। অথবা পরিচয় ছবির "বিতি না বিতায়ি রহনা"।

বিতি না বিতায়ি -


"বড়া নটখট" সম্বন্ধে গল্প চলে যে সাধাসিধেভাবে রাগের চালু বন্দিশে ফেলে কাজ সারতে চেয়েছিলেন রাহুল। বাবা বর্মন নাকি ছেলে বর্মনকে কড়কানি দেন এই বলে যে, এই গানে তুমি কী যোগ করলে? যে কোন সঙ্গীত পরিচালকই তো রাগে ফেলে এই গান বানাতে পারে। এই ধাঁতানির পরে শোনা যায় রাহুল গানটিকে খাম্বাজে রেখে নতুন করে সাজান। শেষ পর্যন্ত যে গানটি দাঁড়ায় সেটি এই -

বড়া নটখট -

(চলবে)