শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০১৬

আয়না, ঝর্ণা ও রাহুল

চার-পাঁচ বছরের স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়। নেইও। তাও হঠাৎ স্মৃতির দু-চারটে ঝলক চলে আসে। সেইরকম কিছু ঝলক থেকে হয়ত বানিয়ে বানিয়ে পোক্ত স্মৃতি বানিয়ে নিয়েছি। সেইরকমই গানের স্মৃতি। ছেলেবেলার, মানে ওই বয়েসের, গান-সম্বন্ধীয় মাত্র দুটো স্মৃতি আছে আমার।

একটা হল, আমাদের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়ির রান্নাঘরে পা ঝুলিয়ে বসে আছি আর বাইরে মাইকে বাজছে "কাঞ্চি রে কাঞ্চি রে, প্রীত মেরি সচ্চি"।

দ্বিতীয় স্মৃতিটা মজার। পিশতুতো ভাইবোনেরা এসেছে ছুটিতে। বাংলায় স্নো-হোয়াইট নাটক করা হচ্ছে। সত্যেন দত্তর একটা কবিতা আছে - 

ঝর্ণা, ঝর্ণা, সুন্দরী ঝর্ণা।
তরলিত চন্দ্রিকা
চন্দন-বর্ণা।।

এর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে স্নো-হোয়াইটের জন্যে সেজকাকাই বোধহয় লিখে দিলেন -

আয়না, আয়না, সুন্দরী আয়না
সব থেকে সুন্দরী
কে আমায় বলনা।

মনে আছে, এটা আমরা গলা ছেড়ে একটা মিষ্টি সুরে গাইতাম। সুরটা এতই মিষ্টি আর সোজা যে সেটাকে অনেকদিন বয়ে বেড়াতে পেরেছি।

এর অনেকদিন পরে, ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি বোধহয়, একদিন চিত্রহারে হঠাৎ একটা গান শুনে চমকে উঠলাম। আরে, এই তো সে আয়নার গান। ওরফে ঝর্ণার গান। কিশোরকুমার গাইছেন -

রোনা, কভি নহি রোনা
চাহে টুট যায়ে
কোই খিলোনা।



সুরটা শুনে দেখুন। তারপরে সেই সুরে "ঝর্ণা, সুন্দরী ঝর্ণা" গান, দেখবেন খাপে খাপ মিলে গেছে।

কিন্তু সেটা কথা নয়। কথা হল, ছেলেবেলার যে গান মনে রয়ে গেল, বোধহয় অবচেতনেই, সে গানদুটোই গেয়েছিলেন কিশোরকুমার আর, মনে হয় তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, দুটোই সুর করেছিলেন রাহুল দেব বর্মণ।

সায়েবরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন শিশু, মানে একেবারে কয়েকমাসের শিশুদের ওপর মোৎজার্টের সঙ্গীতের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আছে।

তবে কি রাহুলেরও আছে?

শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১৬

বাংলা স্কুল

ছ বছর বাংলা বয়েজে পড়ে যখন বাংলা কো-এডে ভর্তি হলাম তখন আমি নেহাতই আনকোরা। একেবারে গ্রীন। প্রথম দিনই ক্লাসের বাঘা বাঘা ছেলেরা ইন্টারভিউ নিল। কোন স্কুল থেকে এসেছি, ক্লাসে কটা মেয়ে ছিল, নিরোধ কি, সত্যম শিবম সুন্দরম দেখেছি কিনা - এইসব। তারপরে গালাগালির ইন্টারভিউ। সে সব তো পাশ করে গেলাম। টিফিনের সময়ে লাইব্রেরির সামনের মাঠে রবারের বলের ফুটবল দলে চান্সও পেয়ে গেলাম। কো-এড ইশকুলের জীবন শুরু হয়ে গেল। সত্যি বলতে কি বয়েজ স্কুল আর কো-এড স্কুলের পার্থক্য কখনই প্রকট হয়নি।

তবে জাগতিক ব্যাপারে একেবারে উদোমাদাচন্ডীচরণ ছিলাম না। বার্ডস-অ্যান্ড-দ্য-বীজ সম্বন্ধে সবাইকারই জানাশোনা ছিল। তবে তার থেকে অনেক বেশি মুখরোচক ছিল গাভাসকার-বিদেশ বসু-এন্টার-দ্য-ড্রাগন। আর ছিলেন মিস্টার বচ্চন। 'অনুসন্ধান' এসে গেছে, 'শান' আসব-আসব করছে। বহু ছেলে 'আমি বলছিলাম কি' বলে অনুসন্ধান-স্টাইলে কথা বলা শুরু করছে। এসে গেছে সুখেন দাসের অমর ছবি 'প্রতিশোধ'। চিত্রমালায় দেখেছি বাস-থেকে লাফিয়ে ধানক্ষেতে নেবেই সুখেন দাস গান ধরেছেন 'হয়ত আমাকে কারো মনে নেই'। মাইকে বাজছে 'ইয়াম্মা ইয়াম্মা'।

মেয়েরাও ছিল। পেরিফেরাল ভিশনে। ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব হল অনেক পরে। সেভেন-এইট অব্দি ছিল মূলতঃ ঝগড়ার সম্পর্ক। অরূপের বাবা পুলিশে কাজ করতেন। পুলিশি ঐতিহ্যে অরূপ সারাটা স্কুল-জীবন অ্যায়সা মোটা সোলের সবুজ ক্যানভাসের জুতো পরে এল। সেই জুতো পরে অরূপের ফুটবল খেলা বারণ ছিল। চার্জ করা যেত না। ক্লাস সেভেনে একবার সঙ্ঘমিত্রার সঙ্গে অরূপের ঝগড়া লাগল। ঝগড়া থেকে লাথালাথি। ওই জুতো পরে। আমরা ছেলেরা অরূপকে উৎসাহ দিলাম। মেয়েরা সঙ্ঘমিত্রাকে। তারপরে ভুলে গেলাম।

দুপুরে সবদিন ফুটবল খেলা যেত না। বল থাকত না বা মাঠ পাওয়া যেত না। সেসব দিন আমরা কিং-কিং বা চোর-পুলিশ খেলতাম। চোর-পুলিশ হলে পেছনের অডিটোরিয়ামের ছাতে। সিঁড়ির ভাঙা কাঁচের জানলা দিয়ে গলে। সেই ছাতেই ছিল স্কুলের জলের ট্যাংক। শৈবাল একদিন ট্যাংকে হিসি করে দিল। আমরা পরের সাতদিন কেউ স্কুলে জল খেলাম না। খুব তেষ্টা পেলে সামনে বারিকদের বাড়ির প্যাসেজের কল থেকে গিয়ে জল খেয়ে আসতাম। স্কুলের বাকি কেউ জানত না। অন্যরা হুহা সেই জলই খেল। স্টুডেন্ট-টীচার-হেডু সবাই।

এই করতে করতে একদিন হঠাৎ দেখি, বড় হয়ে গেছি।

বুধবার, ২২ জুন, ২০১৬

ফেলুদা

তখন বছর-বছর পুজোসংখ্যা দেশে বেরোত ফেলুদা আর আনন্দমেলায় প্রফেসর শঙ্কু। সে সময়ে এখনকার মতন গরম থাকতে থাকতে পুজোসংখ্যা বেরিয়ে যেত না। বেরোত মহালয়ার আশেপাশে সময়ে। একবছর হা-পিত্যেশ করে থাকার পরে যখন দেশ বাড়িতে এল, দেখি ভো কাট্টা। নো ফেলুদা। কোন সাল সেটা? ৮০? ৮২? সেবার ফেলুদা বেরোল সন্দেশ পুজোসংখ্যায়। হত্যাপুরী। শুরুটাও অন্য ফেলুদার থেকে আলাদা। "ডংলুর কথা" দিয়ে। তারপর থেকে সেটাই রেওয়াজ হয়ে গেল। একবার দেশ পুজোসংখ্যায় ফেলুদা, আরেকবার সন্দেশে।

এর আগে সন্দেশে ফেলুদার দারুণ সব গল্প বেরিয়েছে। প্রথম ফেলুদা "ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি"-ই তো সন্দেশে। "ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা", "গোঁসাইপুর সরগরম", "সমাদ্দারের চাবি" - এ সবই সন্দেশে। তবে পুজোসংখ্যায় নয় বোধহয়। প্রোফেসর শঙ্কুও সন্দেশে শুরু। "একশৃঙ্গ অভিযান" মনে আছে সন্দেশে ধারাবাহিক বেরিয়েছিল। আমি পরে বাড়ির বাঁধান সন্দেশে পড়ি।

আজ হঠাৎ ইউটিউবে "গোঁসাইপুর সরগরম" দেখে মনে পড়ল এইসব। ফেলুদার গল্পে ডিটেকশন তো খুব স্ট্রং থাকত না। তাও সন্দেশের ওই "ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা", "গোঁসাইপুর সরগরম", "সমাদ্দারের চাবি" ইত্যাদিগুলোতেই যা একটু ডিটেকশন পাওয়া যেত। আর এগুলোর পটভূমিকাও মফস্বলি বাংলা বা গ্রাম বাংলা। সত্যজিৎ দু-চার কথায় সেটারও মাহোল যেরকম তৈরি করতেন, আমার খুব ভাল লাগত। একবার লিখেছিলেন, "কলকাতার বাইরে এলেই কীরকম ঝপ করে সন্ধ্যে নেবে যায়!" বা "কলকাতা থেকে বেরলেই সবুজ দেখে চোখের আরাম হয়।" - অবশ্যই প্যারাফ্রেজ করে লিখলাম। বাকি সবও স্মৃতি থেকে আন্দাজিফিকেশন।

এখন আর ফেলুদা পড়তে ভাল লাগে না। কিন্তু ফেলুদা পড়ার ছেলেবেলার স্মৃতি ভাবতে এখনও ভাল লাগে।

ধনেশ পাখি

এটা না বললেই নয়। এর আগে অন্যত্রও একবার বলেছি।

আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়ত অসীম। অসীম দাস। সত্যি নামটা বলছি না। অসম্ভব আমুদে ছেলে। এবং কালারফুল। সেইসঙ্গে দারুণ হাজির-জবাবের ক্ষমতা। আর ছিল মজার-মজার এবং ইনোভেটিভ গালাগালির অফুরন্ত স্টক। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে মুজতবা আলী, স্নেহাংশু আচার্য - এইসব দিকপালদের উত্তরসুরী সে। অসীম ছাড়া কোন আড্ডা, বেড়াতে যাওয়া-টাওয়া ঠিকমতন জমত না। কলেজে একদিন না এলে ফাঁকা-ফাঁকা লাগত। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে গোয়া বেড়াতে গিয়ে এক রাত্তিরে লাস্ট-বাস মিস করে ভ্যাগেটর বিচ থেকে সাড়ে তিনঘন্টা হেঁটে ক্যালাঙ্গুটের ডর্মিটরিতে ফিরতে হয়েছিল আমাদের জনা পনেরোকে। তার মধ্যে আদ্দেক রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজে। সেই পুরো রাস্তাটা অসীম আর আমাদের আরেক বন্ধু নন-স্টপ গালাগালির কম্পিটিশন শোনাতে শোনাতে নিয়ে এসেছিল। 

অসীম ছিল প্রেমিক। সম্ভব-অসম্ভব বিভিন্ন রকমের প্রেমে অতি দ্রুততার সঙ্গে পড়ে যাওয়ায় অসীমের কোন জুড়ি ছিল না। কিন্তু সেগুলো সবই একতরফা। ফলে একটা প্রেমও শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। হবে কী করে? বন্ধুদের কাছে অতি সরব হলেও, যেখানে আসল কথাটি বলার - সেখানে একেবারে সাইলেন্ট। কিন্তু তার জন্যে অসীম যে দেবদাস-পানা “আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে” হয়ে বসে থাকবে, সেরকম কোন সিনই নেই। অত্যন্ত স্পোর্টিং প্রেমিক ছিল সে। আর ওইসব উচাটনও দিন কয়েকের মধ্যে মানবমনের গভীরে বিলীয়মান হয়ে যেত।

তো এমতাবস্থায় একদিন অসীম চৈতালী (কাগজের ভাষায়, নাম পরিবর্তিত) বলে তাদের হাউজিং-এর একটি মেয়ের প্রেমে পড়ল। পড়ল মানে একেবারে পড়েই রইল। আমরা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলেই কম্পালসারিলি অসীমের প্রেমের প্রোগ্রেস রিপোর্ট শুনতাম আর নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধি মতন পরামর্শ দিতাম। যেমন অসীম বলল, 'আজ মাইরি হাউজিং-এ ব্যাডমিন্টন খেলছিল চৈতালী। কতক্ষণ আর ডাইরেক্টলি ঝাড়ি করা যায়! তাই ছক করে ওর ভাইকে ডেকে ধনেশ পাখি দেখালাম"। ধনেশ পাখি? বেহালার হাউজিং-এ? দেখিয়েছে হয়তো চড়াই। অসীম বলল, "চৈতালীর ভাইকে বলার জন্যে এই নামটাই সবথেকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট মনে হল।" একদিন হয়তো বলল, "একটা ছেলে শালা চৈতালীকে ছক করছে। কী করা যায় বল তো?" অমুকে বলল, “বেনামী চিঠি দে।” একজন বলল, “তক্কে-তক্কে থাক। একদিন বাসে দেখতে পেলে পকেটমার বলে কেলিয়ে দিবি।” এইরকম চলছে।

এক সেমেস্টার পরীক্ষার সকালে কলেজে গিয়ে দেখি অসীমের মেজাজ পুরো বিলা। দেবদুলালীয় শোকবার্তা স্টাইলে ঘোষণা করল, "কাকা, আজ সব শেষ।” “সে কী?” অসীমের বয়ানে - “সকালে শালা এমনিই মেজাজ খারাপ - সেমেস্টারে ৩২ আস্কিং - বাজার থেকে ফিরছি, চৈতালীর বাপ ধরেছে। রোজই ধরে, আর রোজই এক প্রশ্ন। কি অসীম, বাজার থেকে ফিরছ নাকি? বাঁ... দেখছ সক্কালবেলা হাতে থলি, বাজার থেকে ফিরব না তো কি বেশ্যাবাড়ি থেকে ফিরব? তাও চৈতালীর বাপ তো, গম্ভীর হয়ে বললাম, হ্যাঁ বাজার। তখন বলে কেমন বাজার হল? বাজার আবার বালের কেমন হবে? বললাম, ভালোই। মাছ কিনেছো? হ্যাঁ। তখন জিগেস করে, কী মাছ কিনলে। আমার বাঁ ... আজ অ্যায়সা মটকা গরম হয়ে গেল, বলে দিয়েছি, বড় বড় তিমিমাছ কিনেছি। সস্তায় দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি যান। এখনও আছে।"

সোমবার, ১৩ জুন, ২০১৬

নাট্যারম্ভ

আমি বহু বছর বিদেশে নাটক করেছি, বুঝলেন। বেশ সিরিয়াসলি। খাটাখাটনি করেছি। কয়েকবার তো নিজেরা লিখে - একবার প্রায় ওয়ার্কশপের মতন করে। তার সঙ্গে প্রতিবারই নিজেরা সেট ডিজাইন করেছি, বানিয়েছি; লাইট ডিজাইন করেছি; মিউজিক বানিয়েছি-বাজিয়েছি-রেকর্ড করেছি ইত্যাদি। সঙ্গে তো অভিনয়, পরিচালনা ইত্যাদি আছেই। আর আছে মার্কেটিং, টিকিট বিক্কিরির বিভীষিকা। সে এক, যাকে বলে, বিশাল কর্মযজ্ঞ। এর সবই একেবারে শূন্য থেকে শিখতে হয়েছে। আমাদের মধ্যে এর আগে সিরিয়াস নাট্যচর্চা করেছিল একমাত্র অমিতাভ (Amitava Baksy), আর কিছুটা বোধহয় ইন্দ্রাণী। কিন্তু-কিন্তু করে এও বলি যে প্রোডাকশন কোয়ালিটিও একেবারে দুচ্ছাই কিছু হতনা, কিছু ক্যাপটিভ অডিয়েন্সও তৈরি হয়েছিল। এসবই হয়েছে কিছু সমমনস্ক, নাটুকে আর খাটতে-ও-শিখতে-ইচ্ছুক নারী-পুরুষ এক সময়ে এক জায়গায় জড় হয়েছিলাম বলে।

কিন্তু আমার নাটকের জীবন দীর্ঘতর, সেটা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। এই সুদূরপ্রসারী নাট্যজীবন শুরু হয়েছিল নামভূমিকায় অভিনয় দিয়ে। "গাধা-পিটিয়ে-মানুষ" নাটকে গাধা, "কালো কুকুর" নাটকে কুকুর - নটসূর্য হবার দিকে এই ছিল যাত্রারম্ভ।
 
এর বহু পরে, কলেজে পড়াকালীন পাকামি ও আঁতলামির বিছে যখন কামড়াল তখন কয়েকজন বন্ধু মিলে দল গড়ে নাটক করতে শুরু করলাম। একজনেরও পুজোর নাটকের বাইরে নাটক করার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। তাতে কি ডরাই কভু ভিখারী রাঘবে? বাংলায় কেউ নাটক লিখতে পারে? ধুর ধুর। আমরা দেখিয়ে দেব। মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। একেবারে ইবসেন। Ghosts. অনুবাদ আছে না? আছে, কিন্তু ছ্যা ছ্যা, অন্যের অনুবাদ নিবি কি রে! নিজেরা আনুবাদ কর। অভিজ্ঞতা তো নেইই, কনফিডেন্সও নেই। তাই তিনবন্ধু একেক জন একেকটা অঙ্ক অনুবাদ করলাম। বাংলা সাহিত্যকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে সে অনুবাদ বা অনুবাদগুচ্ছ কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে যদিও। বাঁচা গেছে। নইলে যে কী হত, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। দলের কারুর নাটকের অভিজ্ঞতা ছিলনা বলে যে লিখেছি, সেটা ঠিক লিখিনি। টুকটুকির ছিল। দলের দুজনের মধ্যে অন্যতম মহিলা সদস্য। টুকটুকি অসম্ভব ভাল আবৃত্তিও করত, আজকাল যাকে বাচিক শিল্প বলে।

সে নাটক একেবারে টপ-টু-বটম ডিজাস্টার। দলের নাম নৈর্ব্যক্তিক। আর্দ্ধেক লোক উচ্চারণই করতে পারল না। নাটকের নাম আবর্ত। আমার কাকা বলেছিল, পাকামি কোরোনা। স্পিন বল দেবার আগে সোজা বল দিতে শেখ। কে শোনে কার কথা! নাটকের আগে শ্যমাবাজারে গিয়ে মেকাপ আর সেটের বরাত দিয়ে এলাম। "জমিদার বাড়ির সেট তো? হয়ে যাবে।" লাইটের বরাত পেল সল্ট লেকের বৈশাখীর একজন। পাড়ার পুজোর নাটকে লাইট করেছিল। মানে দুদিকে দুটো লাইটের সামনে মুড অনুযায়ী লাল-নীল কাগজ-ধরা। তাৎক্ষণিক। স্ক্রিপ্ট-টিপ্ট পড়ার কোন গল্প নেই। নাটকের দিন মেকাপ আর লাইট এল। সেট আর এল না। লাইটের লোক বলল, "জমিদার বাড়ির সেট করে দেব"? তাই সই। লোকের হাতে-পায়ে ধরে টিকিট বেচা হয়েছে। টিকিট তো নয়, গেস্ট কার্ড। কারণ টিকিট হলে এন্টারটেনমেন্ট ট্যাক্স না কী একটা দিতে হবে। সে ট্যাক্স মকুব করা মহা ঝামেলা। তো নাটক শুরু হবে সাতটায়। লোকজন গুটিগুটি আসতে শুরু করেছে। সাড়ে ছ'টা নাগাদ লোডশেডিং হয়ে গেল। কুছ পরোয়া নেহি। হলে জেনেরেটর আছে। চালাও জেনেরেটর। কিন্তু জেনেরেটরের লোক গলদঘর্ম হয়ে গেল। জেনেরেটর আর চালু হয়না। ম্যানেজার এসে পড়লেন। সরকারী কর্মচারী। নাটকের একটি মূল চরিত্র তাকে চমকাতে গিয়ে পুলিশের হুমকি খেল। সে একে কেলেংকারিয়াস প্যান্ডেমোনিয়াম। শেষ অব্দি আলো এসে নাটক শুরু হল বোধহয় রাত ন'টা নাগাদ। ততক্ষণে ষাট শতাংশ দর্শক - মানে যারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিংবা আত্মীয় নয়, তারা পাতলা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস। কারণ সে যা নাটক হয়েছিল!

এরপরেই বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে দলটির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। তবে সত্যের খাতিরে এও বলে রাখা ভাল আমরা আরও একটি নাটকের মহড়া শুরু করেছিলাম। সে নাটক আর মঞ্চস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। নাটক ও নাট্যকার খুব বেঁচে গেছেন। আমরা তথৈবচ।

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

মোটা

আমি ডাকি মোটা বলে। স্কুলে ছ'বছর, আর তারপরে কলেজে চারবছর একসঙ্গে পড়েছি। তাছাড়া মোটারা থাকতও সল্ট লেকে খুবই কাছে। আমরা সিডি ব্লক, মোটারা এবি ব্লক। কোণাকুণি দেখলে মাঝখানে একটা মাত্র ব্লকের ব্যবধান - বিসি। এই নৈকট্য পরে খুব সুবিধে দিয়েছে।

মোটার মতন বন্ধুবৎসল ছেলে খুব কম দেখেছি। বন্ধুবৎসল এবং অসূয়াহীন। কম নয়, দেখিইনি। কলেজে অন্যরা ক্লাস করছে না। এমনিই করছে না। মোটাকে ক্লাস করার জন্যে তারা ব্যাগড়াও দিয়েছে। তাও মোটা ক্লাস করে যে শুধু নোট নিচ্ছে তাইই নয়, এক্সট্রা দুটো কার্বন কপিও নিচ্ছে। কোন বন্ধুর কখন কাজে লেগে যায়, কে জানে!
বাড়ি ফেরার মুখে মোটা বলল, "দশ টাকা দে।" দিয়ে দিলাম। পরের দিন মোটা কটা খুচরো পয়সা আর একগাদা জেরক্স-করা পাতা দিল। স্যার কোন বইয়ের রেফারেন্স দিয়েছেন। মোটা নিজের জন্যে কপি করছিল, অন্যরা বঞ্চিত হবে কেন? তাই নিজে উপযাচক হয়ে সবাইকার জন্যে জেরক্স করে দিয়েছে। অনেকবার।

মোটার দোষ বলতে, মোটা ক্লাস করতে খুব ভালবাসত। শুধু ক্লাস করতেই নয়, মোটা পড়াশুনো করতেই ভালবাসত। কলেজে, ক্লাসে মোটামুটি সবাই রাজী হয়েছে মাস কাট দিতে, কিন্তু বেঁকে বসল মোটা আর রাজা। এরকম বহুবার হয়েছে যে ক্লাসে শুধু মোটা, রাজা আর প্রফেসর। ক্লাসের বাকিরা ভিতর হতে বাহির হয়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল বাহিরে গাছতলায় বসে কালাতিপাত করছে। পরে এই আমরাই ক্লাস টেস্টের আগের রাতে বা এমনকি সেমেস্টার পরীক্ষার আগের রাতে মোটার বাড়িতে হানা দিয়েছি। মোটা নিজের নোট দিয়ে দিয়েছে ব্যাকবেঞ্চারগুলোকে। আমার লাইব্রেরি কার্ড তো চারটি বছর মোটার কাছেই গচ্ছিত ছিল। মোটাই আমার জন্যে বই তুলত, আমাকে পড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করত, আবার ফেরত দিয়ে দিত।

পরে ভেবে মনে হয়েছে মোটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া উচিত হয়নি। বাবার মতন পলিটিকাল সায়েন্স বা অন্য কোন সোশ্যাল সায়েন্স পড়া ভাল হত। তবে সে তো এখন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করে প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউটে পড়াচ্ছে আর হিল্লি-দিল্লি-বিলেত করে বেড়াচ্ছে। খান চারেক বইও প্রকাশ করে ফেলেছে।

মোটার যে গল্পটা ফোকলোর হয়ে গেছে, সেটা বলি। ইশকুলের গল্প। ক্লাস ইলেভেন। মোটার গায়ে অমানুষিক শক্তি ছিল। কিন্তু মুশকিল হল মোটা সেটা জানত না। এর ফলে অনেক ছেলে অকারণে আহত-টাহত হয়েছে। সে যাক। ইলেভেনে, ক্লাসে সাত রো বেঞ্চির দ্বিতীয় সারিতে মোটা বসত। একবার টিফিনের পরে মোটার প্যান্টের বেল্টের লুপে একটা মোটা নারকোল দড়ি দিয়ে ল্যাজ করে দেওয়া হল। মোটা টের পায়নি। ল্যাজটা লম্বা। খুব লম্বা। এত লম্বা যে তার অন্য দিকটা শেষ, মানে সাত নম্বর, সারিতে বেঞ্চির পায়ায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। একদম মোরম্বা করে। আর সেই বেঞ্চিতে গাদাগাদি করে ছ'টা উঠতি জোয়ান ছেলে বসে ক্লাস করছে। বেঞ্চি নড়ে যাবার কোন সিনই নেই। এরপর বিজয়াদি ক্লাসে এসেছেন। এসে মোটাকে কিছু একটা জিগেস করেছেন। মোটা ক্লাসে জবাব-টবাব দিতে খুব ভালবাসত। তো জবাব দেবে বলে উৎসাহভরে উঠতে গিয়ে মোটা ল্যাজে ঠেকে গেল। উঠতে পারল না। তখনও বুঝতে পারেনি কিসে আটকাচ্ছে। আবার ওঠার চেষ্টা করল। আবার আটকাল। তিন নম্বর বারের বার সর্বশক্তি দিয়ে মোটা উঠে দাঁড়া্তেই পেছনের বেঞ্চির পায়াটি মোটার শক্তির কাছে পরাভূত হয়ে নিজের কাজে ইস্তফা দিল এবং ছ'টি সা-জোয়ান ছেলে ভূমি নিল। এ জিনিস চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

মোটা, শুনছিস?

মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০১৬

সেবোনিয়ার

সত্যজিৎ রায়ের একটা গল্পে হ্যামিলটনের মাঠ বাঙালি উচ্চারণে হামলাটুনির মাঠ হয়ে গেছিল। লেডি ক্যানিং থেকে লেডিকেনির নাম হওয়ার গল্প তো প্রায় সবাই জানেন, যদিও এখন সেই গল্প জিজ্ঞাসার চিহ্ণ পড়েছে। এছাড়া প্ল্যাটুন থেকে পল্টন, প্লায়ার্স থেকে প্লাস - এসব তো আছেই।

আমাদের কলকাতার বাড়িতে একটা চেস্ট-অফ-ড্রয়ার আছে। তার নাম সেবোনিয়ার। পল্টনেও তাকে নড়াতে পারে না, এমনই ভারী। আমি তাকে জন্মাবধি দেখে আসছি। চারতলা দেরাজ, আমরা টানা বলতাম। প্রত্যেক তলায় একটা সাড়ে তিন-চার ফুটের গভীর ড্রয়ার। সব থেকে ওপরের তলায় তার আদ্ধেক-চওড়া দুটো ড্রয়ার। আজকালকার মতন ফ্যান্সি রেল লাগান ফঙ্গবেনে জিনিস নয়। একদম সলিড। এক-একটা দেরাজ টেনে বের করতে কালঘাম ছুটে যায়। গামা পালোয়ান না লাগলেও সে যার-তার কম্ম নয়। সে কী আর আজকের জিনিস? বহু পুরনো। বোধহয় ওম্মার বিয়ের যৌতুক। মানে আদি উনিশশো ব্রিটিশ সালের মাল। বার কয়েক পালিশ করা সত্বেও আবার সে প্রায় আবলুশ কাঠের মতন কালো হয়ে গেছে। ছোট থেকে জিনিসটাকে "সেবোনিয়ার" বলে ডাকতে শুনেছি। আর কারুর বাড়িতে "সেবোনিয়ার" আছে বলে কোনদিন শুনিনি। নামটায় কীরকম যেন ফ্রেঞ্চ-ফ্রেঞ্চ গন্ধ। আমি থোড়িই ফরাসি জানি! ওই গন্ধ অব্দিই দৌড়। কাজেই জিনিসটার সত্যিকারের যে কী নাম জানতে পারিনি। তারপরে ভুলেও গেছিলাম। সেদিন মনে পড়াতে সার্চ করতে গিয়ে দেখি কোন আন্দাজী বানানেই কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে ঘুরপথে খুঁজে পেলাম। ফ্রেঞ্চই। chiffoniere। সেখানে থেকে ব্রিটিশ বা মার্কিনি chiffonier বা chiffonnier। বাঙালি উচ্চারণে শিফনিয়ের থেকে কীভাবে যেন সেবোনিয়ার হয়ে গেছে। (আসল ছবি নেই।)


শুক্রবার, ৩ জুন, ২০১৬

জগাদাদা

আমাদের বাড়িতে কাজ করত জগাদাদা। ঊড়িষ্যার লোক। কিশোর বয়সে কাজ করতে এসেছিল কলকাতায়। সে আমার জন্মের ঢের আগে। তখন বাড়িভর্তি লোক। শুনেছি জগাদাদা নাকি আমাদের বাড়িতেই চুরি করে ধরা পড়ে যায়। চাকরি গেছিল কিনা জানিনা, কিন্তু যোগাযোগ যায়নি। "পুরাতন ভৃত্য" ট্র্যাডিশন। পরে বাবা কোথায় কী কলকাঠি নেড়ে সরকারী অফিসে পিওনের চাকরি করে দেয় জগাদাদার।

তারপর থেকে মাঝে মাঝে, দু-চার মাস অন্তর, রোববার করে চলে আসত বেলা দশটা-এগারোটা নাগাদ। কাজ-টাজ কিছু করে দিত। পাখা পরিস্কার করবে? দাঁড়া, জগা আসুক। কুলুঙ্গি থেকে জিনিস পাড়তে হবে? দাঁড়া জগাকে খবর দিই। এরকম সব ব্যাপার। ধুতি কোঁচান তো দেখেছি জগাদাদা ছাড়া হতই না। আর জগাকে দেখলে আমার বাবার গা-টেপানো পেয়ে যেত। সারাদিন থাকত জগাদাদা। কাজকর্ম করে দিত, খাওয়া-দাওয়া করত। গল্পগুজব করত, মূলতঃ ওম্মার সঙ্গে। তারপরে সন্ধ্যে-রাত্তিরের দিকে চলে যেত। বাড়িতে কারুর বিয়ে-টিয়ে হলে দুদিন আগে জগাদাদা চলে আসত আর একা হাতে বহুদিক সামলাত। যগ্যিবাড়ির বাজার হবে কলেজ স্ট্রীট থেকে - জগাদাদা। গায়ে হলুদের মাছ আনতে হবে - জগাদাদা। বিয়ের ফুল - জগাদাদা। তার ওপর বিয়েতে নাপিতের কাজও করে দিত জগাদাদা। একদম গ্র্যাটিস। দাদা আর দিদির বিয়ে অব্দি দেখেছি এই চলেছে। আর ওইসময়ে বার-দুত্তিন এরকম হয়েছে যে আমরা বাড়ি ফাঁকা করে সদলবলে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি, জগাদাদা এসে বাড়িতে থেকে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। চুরির একটা ইতিহাস থাকায় মা-র মনে খুঁতখুঁতুনি দেখেছি, কিন্তু আবার ভরসা করে ছেড়ে যেতেও দেখেছি। 

জগাদাদার এক না দুই ছেলে ছিল। মাঝেমাঝে এসে বলত ছেলে অমুক ক্লাস। একদিন বলল ছেলে মাধ্যমিক পাশ করেছে, উচ্চ মাধ্যমিকও পাশ করল। ছেলের চাকরি পাওয়ার কথাও যেন শুনেছিলাম। আমি ৯৩ সালে দেশ ছাড়ি। নব্বইয়ের দশক থেকেই জগাগদাদার আসা কমে যেতে থাকে। বয়েসও হচ্ছিল। ১৯৯৭-তে ওম্মা মারা যাবার পরে সে আসা আরও কমে যায়। শুনেছিলাম রিটায়ার করে জগাদাদা ঊড়িষ্যায় নিজের ভিটেতে ফিরে গেছে।

এখন তো কেউ চাকর-ঝি রাখে না। বাড়িতে কাজের লোক বা কাজের মাসী কাজ করে। কিন্তু তাদের সঙ্গে এই দীর্ঘ ওঠা-পড়ার সম্পর্ক কি তৈরি হয়? কে জানে!

বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১৬

পুরানা সল্ট লেক

সল্ট লেক তখনও ফাঁকা ছিল। বাড়ির থেকে ফাঁকা প্লটের সংখ্যাই বেশি। সেক্টর ওয়ানেই। যারা সল্ট লেক ভাল চেনেন তারা বুঝবেন কতটা ফাঁকা যদি বলি যে তিন নম্বর ট্যাঙ্ক থেকে বিডি মার্কেট যাবার রাস্তায় ডানদিক (সিডি ব্লকের দিকটা) পুরোটা খালি ছিল। কিম্বা তিন নম্বরের আইল্যান্ড থেকে বিডির ব্যাঙ্ক অফ বরোদা বাস-স্ট্যান্ড অব্দি গোটা চার-পাঁচ বাড়ি ছাড়া বাকিটা খোলা মাঠ। আর সে মাঠে তখনও মাটি জমাট বাঁধেনি। ঘাসের তলায় সাদা বালি পাওয়া যেত।
বিডি স্কুল তখন একটি মাত্র দোতলা বাড়ি। মাঝে শান-বাঁধান উঠোন তখনও শান-হীন, কোণের জলখাবার জায়গাও হয়নি। 

এখন যেখানে সিটি সেন্টার - ডিসি ব্লক - সেখানে একটাও - ইয়েস একটাও - বাড়ি ছিলনা। ছিল শুধু সুচারু স্তুপ করে রাখা স্টোনচিপ। তার উল্টোদিকে, যেখানে মনজিনি'স-এর দোকান-টোকান আছে - ডিডি ব্লক, সেও অধিকাংশই খালি, শুধু হসপিটাল আর সেবা। আর মোড়ের মাথায় তৈরি হতে শুরু করল "শিবম" নামের সিনেমা হল। সল্ট লেকের প্রথম হল। কিন্তু সে আর শেষ হল না। ইতিহাস নিয়ে ধংসস্তুপ হয়ে তার কংকাল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আর ফাঁকা ছিল বিদ্যাসাগর হাউসিং-এর সামনের মাঠ। পুরো ফাঁকা। বিদ্যাসাগরের গেট থেকে সেন্ট্রাল স্কুল দেখা যেত পরিস্কার।
একেবারে আক্ষরিকভাবেই চোখের সামনে তৈরি হল ডি সি পালের বাড়ি, ইসি স্কুল - এডি স্কুলের মেয়েরা সেখানে স্থানান্তরিত হয়ে গেল, সল্ট লেক স্টেডিয়াম - প্রথম খেলা ১৯৮৪ সালের নেহেরু কাপের ফাইনাল, প্রথম পেট্রল পাম্প - স্টেডিয়ামের উল্টোদিকে, বিদ্যুৎ ভবন। করুণাময়ী ভরে উঠল। ওদিকে পূর্বাচল, কালোবাড়ি, মহাবীর বিকাশ। সিটি সেন্টার-টেন্টার তো এই সেদিনের ছোকরা - হয়েছে আমি দেশ ছাড়ারও পরে।
বড় পুজো বলতে লাবণী, বিডি ব্লক আর এই ব্লক। যদিও প্রায় প্রতি ব্লকেই পুজো হত। এফডি ব্লক নাম করল নব্বইয়ের দশকে এসে। প্রথম রেস্টোর‍্যান্ট বিই ব্লকের ড্যান-ডিন। প্রথম নামী স্টুডিও - স্টুডিও মনোরমা। সিএ মার্কেট বা বিডি মার্কেটে কোন স্টুডিও ছিল বলে মনে পড়ছে না। তবে বিডি মার্কেটের দোতলায় একটা লাইব্রেরি ছিল। কিরীটি থেকে শুরু করে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের "বলাকার মন" - কিচ্ছু বাদ দিইনি।

আমরা যখন সল্ট লেকে গেছি তখন বাস বলতে ৪৬এ, ৪৪এ, ৯, এস-১৪, এস-১৬, এল-১৪এ, এল-১৪বি, সল্ট লেক-যাদবপুর মিনি। আর কোন মিনি চলত বল মনে পড়ছে না। অটো তখনও আসেনি কলকাতায়। খুব চলত সাইকেল রিক্স। আর ছিল সাইকেল - ছেলে থেকে বুড়ো।


আর ছিল ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কই সল্ট লেকের প্রাণভ্রমরা, সল্ট লেকের নিশানা।

খাবার-দাবার

আজ একটা দোকানে খাবার কিনতে গেছিলাম। ছেলেটি আমার পদবী শুনে জিগেস করল আমি কোথাকার বাঙালি? বললাম, কলকাতার। জানলাম, সেও কলকাতার। বাড়ি জাকারিয়া স্ট্রীটে। বড়বাজারেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। হোটেল ম্যানেজমেন্ট করে অ্যামেরিকায় এসে রেস্টোরেন্টে কাজ করছে। আদতে উত্তর প্রদেশের লোক। নাম শাইর কুরেশি। বাপ-দাদা-কাকাদের মাংসর দোকান সারা কলকাতায় ছড়িয়ে।




জাকারিয়া স্ট্রীট বলতেই মনে পড়ে গেল "দেশে-বিদেশে"-তে মুজতবা আলী জাকারিয়া স্ট্রীটে কাবাব কেনার কথা লিখেছেন। (আহা, মুজতবা!!) তো তাকে জিগেস করলাম সে সব দোকান এখনও আছে কিনা। বলল, আলবাত আছে। তারপরে, যথারীতি আলাপ চলল খাবার নিয়ে। তার কাছে জানলাম কলকাতার সেরা নেহারি নাকি নাখোদা মসজিদের উল্টোদিকে সুফিয়া রেস্তোঁরায়। বলল, এই রমজান আসছে। এ মরশুমে সুফিয়ার নেহারি না খেলে জীবন বৃথা। তবে যেতে হবে খুব ভোর-ভোর। সাতটার পরে যে নেহারি মিলবে সে একেবারেই এলেবেলে। "আর বিরিয়ানি?" সুফিয়ার পাশেই নাকি আছে আরেক আমিনিয়া। এস্প্ল্যানেডের আমিনিয়ারই ভাই, কিন্তু ফ্র্যানচাইজি নয়, ব্রাঞ্চ নয়। দুটোই আদত। এই জাকারিয়া স্ট্রীটের আমিনিয়ায় নাকি খেতে হয় বিফ বিরিয়ানি আর হালিম। 

দেশে কবে যাব তো জানিনা। কেউ ও তল্লাটে গিয়ে চেখে এলে এট্টু খবর দেবেন। নইলে খুব চিন্তায় থাকব।