রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৪

সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মন - দ্বিতীয় পর্ব


সলিল বা রাহুল কেউই খুব কড়া রাগভিত্তিক গান বানাতে পছন্দ করতেন বলে মনে হয়না । তবে যেহেতু দুজনেই মূলতঃ ছবির জন্যে গান বানাতেন, বিভিন্ন সিচুয়েশনে রাগনির্ভর গান বানাতে হয়েছে । এর বাইরে বেসিক গানে দুজনেই রাগ ব্যবহার করেছেন খুবই নিয়ন্ত্রিতভাবে, এবং প্রায় সব সময়েই রাগরূপকে প্রকট না করে ।

রাগ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সলিল কিন্তু রাগের চলন বা পকড় প্রতিষ্ঠা করে দিতেন প্রথমেই। রাহুল আনতেন এক দু লাইন পরে। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। এমনকি এমনও বলতে পারি যে ব্যতিক্রমের সংখ্যা এত বেশি যে আগের মন্তব্য হয়ত করা ঠিকই নয়। তবু সেই মন্তব্যের স্বপক্ষে কয়েকটা উদাহরণ দিই।

কলাবতী রাগকে ভিত্তি করে সলিল চৌধুরীর বেশ গুটিকয়েক গান আছে । এর মধ্যে ধরা যাক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলায় "ঝনন ঝনন বাজে" গানটি । পঞ্চাশের দ্শকে তৈরি গান। প্রথম লাইনেই কলাবতী পরিষ্কার। অন্তরাতে গিয়ে গানের চলন বদলে যাচ্ছে।

ঝনন ঝনন -

আরেকটা কলাবতীভিত্তিক গান, "লাল পাথর" ছবিতে সবিতা চৌধুরী আর শ্যামল মিত্রর যৌথ - "ডেকোনা মোরে ডেকোনা গো আর"। এখানেও প্রথম লাইন থেকেই রাগ চিনতে অসুবিধে হয়না।

ডেকোনা মোরে -



অথচ এই কলাবতী (বা মিশ্র কলাবতী) রাগে রাহুলের গান - "বল কী আছে গো" নিজের গলায়, যার হিন্দি গেয়েছিলেন মান্না দে ও লতা মঙ্গেসকর জুরমানা ছবিতে, "এ সখী, রাখিকে"। কলাবতীর চলন প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু, গানের আভোগে নয়, অন্তরায় গিয়ে - "চকিত চাহনী যেন দেখেও না দেখা"। আভোগ বা মুখড়ার দু-লাইনে রাহুল রাগকে আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রাখেন।

বল কী আছে গো -

এ সখী -


এরকম আরেকটা উদাহরণ শিবরঞ্জনী রাগে। সলিল করলেন "ধরণীর পথে পথে আমিও পৌঁছে যাব"। গাইলেন একবার সুবীর সেন, একবার লতা মঙ্গেশকর। প্রথম থেকে শিবরঞ্জনী প্রতিষ্ঠিত। এবং সলিলের যা রীতি, অন্তরাতে গিয়ে রাগ গৌণ, সলিলের সুর মুখ্য হয়ে পড়ল।

ধরণীর পথে পথে - সুবীর সেন


রাহুল মিশ্র শিবরঞ্জনীতে করলেন "মেরে নয়না সাওন ভাদো" - মেহেবুবা ছবির জন্যে কিশোরকুমার আর লতা মঙ্গেশকর আলাদা দুটি গান গাইলেন। এখানে পকড়ের ছবি পাওয়া যাচ্ছে, পাশ্চাত্য রক-পপে যাকে গানের হুক বলে সেই অংশে, দ্বিতীয় "ফির ভি মেরা মন পেয়াসা" উচ্চারণে। গানের প্রথমেই নয়।

মেরে নয়না - কিশোরকুমার


এবার উল্টোদিকে - শেষ জীবনে (১৯৯০ সালে) করা গান, নন্দ বা আনন্দী কল্যাণ  রাগে হৈমন্তী শুক্লা গাইলেন, "মন বন পাখী চন্দনা"। প্রথম লাইনের নন্দবাবুকে চিনে নেওয়া গেল।



রাহুল মিশ্র নন্দ রাগে করলেন "যেতে দাও আমায় ডেকোনা"। এখানে বরং প্রথম লাইনে নন্দবাবুকে ধরা যায় কিছুটা।

যেতে দাও আমায় -



সলিল চৌধুরী করলেন অন্তরা চৌধুরীর জন্যে বেহাগ-আশ্রিত "না দির দির দা, তুম না তুম, নাচ তো দেখি আমার পুতুলসোনা", প্রথম লাইন থেকে বেহাগ খুলে পড়া যায়।

না দির দির দা -


যেমন যায় প্রায় একই সময়ে করা - সত্তরের দশকের প্রথম দিকে - "আপ কি কসম" ছবির জন্যে রাহুলের সুরে কিশোরকুমারের "জিন্দেগীকে সফর মেঁ গুজর যাতে হ্যায়" গানে।

জিন্দগীকে সফর মেঁ -


আগেই যে বললাম, খুব কড়া রাগভিত্তিক গান তৈরি করতে কি সলিল, কি রাহুল, কেউই পছন্দ করতেন না। কিন্তু ছবির সিচুয়েশন অনেক সময়ই রাগভিত্তিক গানে চেয়েছে। সেরকম ক্ষেত্রে এনারা রাগের পরিসীমার মধ্যে থেকেই যতটা সম্ভব নিজেদের সাঙ্গীতিক উদ্ভাবনী দেখিয়েছেন। এমনই একটি গান - সলিলের বিখ্যাত হংসধ্বনী, "যা তোসে নহি বলুঁ কানহাইয়া"। একদম রাগদারী গান, প্রথম লাইন থেকেই।



এ গানেরই বাংলা করলেন শেষ জীবনে, গাওয়ালেন হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে -


রাহুল এমতাবস্থায় বহুবার বাবার খজানায় হাত বাড়িয়েছেন - যেমন কিনারা ছবিতে "মিঠে বোলে বোলে" শচীনের বিখ্যাত বাংলা ভৈরবী "মধুবৃন্দাবনে দোলে রাধা"-কে ফিরিয়ে আনে।

মিঠে বোলে বোলে -


মধুবৃন্দাবনে -


অথবা ইজাজত ছবির "খালি হাত শাম আয়ি হ্যায়" গানে ফিরিয়ে আনলেন কর্তার "মালাখানি ছিল হাতে" গানের বন্দিশ।

খালি হাত -


মালাখানি -


অথচ এমনটা নয় যে বাবার খজানা ছাড়া এই ধরণের সিচুয়েশনে রাহুলের কোনরকম অসুবিধে হত। অমর প্রেম ছবিতে "রহনা বীত যায়" কি "কুছ তো লোগ কহেঙ্গে" অথবা "বড়া নটখট হ্যায় ইয়ে" গানেই তার প্রমাণ। অথবা পরিচয় ছবির "বিতি না বিতায়ি রহনা"।

বিতি না বিতায়ি -


"বড়া নটখট" সম্বন্ধে গল্প চলে যে সাধাসিধেভাবে রাগের চালু বন্দিশে ফেলে কাজ সারতে চেয়েছিলেন রাহুল। বাবা বর্মন নাকি ছেলে বর্মনকে কড়কানি দেন এই বলে যে, এই গানে তুমি কী যোগ করলে? যে কোন সঙ্গীত পরিচালকই তো রাগে ফেলে এই গান বানাতে পারে। এই ধাঁতানির পরে শোনা যায় রাহুল গানটিকে খাম্বাজে রেখে নতুন করে সাজান। শেষ পর্যন্ত যে গানটি দাঁড়ায় সেটি এই -

বড়া নটখট -

(চলবে)

বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মন

সলিল চৌধুরী আর রাহুল দেব বর্মন - মেলোডির দুই রাজা । দুজনেই কমার্শিয়াল গানের জগতে নিজেদের পেশাদার জীবন গড়ে তুলেছিলেন । অথচ সঙ্গীতের অপ্রোচে দুজনে দু পথের পথিক । সলিল চৌধুরীর আকর্ষণ জটিল সঙ্গীতিক নির্মাণে, অন্যদিকে রাহুল দেব বর্মন সুরের সহজ চলনে বিশ্বাসী । অ্যারেঞ্জমেন্টে সলিল প্রথম জীবনে ধ্রুপদী - বিশেষতঃ পশ্চিমী আঙ্গিকে, শেষের জীবনে তৎকলীন পশ্চিমী রক-পপ ঘরানার অনুসারী । রাহুল প্রথম থেকেই নিজের মতন পাঁচমিশেলি আঙ্গিক তৈরি করে নিয়েছেন । সলিল চৌধুরী যেখানে ঘন স্ট্রিংস আর বাঁশির বুনিয়াদে সঙ্গীতের প্রাসাদ গড়ছেন, রাহুল দেব বর্মনের সাঙ্গীতিক ইমারত সেখানে পার্কাশান আর গিটার ভিত্তিক ।

কিন্তু সলিল ও রাহুল দুজনেরই কিন্তু সাঙ্গীতিক রসদের ভাঁড়ার লোকসঙ্গীত । দুজনের সঙ্গীতের মূল কিন্তু সেখানেই । তার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকেই মিশেছে পশ্চিমি সঙ্গীতের শ্রবণাভ্যাস । সলিলের ক্ষেত্রে পশ্চিমি ধ্রূপদী সঙ্গীত, রাহুলের ক্ষেত্রে জ্যাজ, পপ ও পরে রক । তার মানে এ অবশ্যই নয় যে দুজনেই সব ধরণের গানে অসামান্য জ্ঞানভান্ডার গড়ে তোলেন নি । সুমন চট্টোপধ্যায়ের লেখায় জানতে পারি নিউ ইয়র্কের কোন এক জ্যাজ ক্লাবে এক জ্যাজ সঙ্গীতকারকে সলিল জ্যাজের কর্ড প্রোগ্রেশন নিয়ে এমন ফান্ডা দিয়েছিলেন যে সেই সঙ্গীতকার স্বীকার করেন এমন ফান্ডাবাজ সঙ্গীতজ্ঞ তিনি আর দেখেননি ।

যদি ধরে নিই যে সঙ্গীতনির্মাণ কোন গভীর মনোবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যেখানে চেতনের থেকে অবচেতনের প্রভাব বেশি - তাহলে অবশ্যই সঙ্গীতের বাইরে আর কী কী এলিমেন্ট এই দুই ধুরন্ধর সঙ্গীত ব্যক্তিত্বর বেড়ে-ওঠা-সময়ে জীবনে প্রভাব ফেলেছিল সেটা জানা এনাদের সঙ্গীত বিশ্লেষনে প্রয়োজন হবে। অথচ এই দিকে গালগল্প যত চলে, ঠিকঠাক তথ্যের চালান তত নেই । সলিল চৌধুরীর তাও অর্ধ-সমাপ্ত একটি আত্মজীবনী আছে, রাহুলের তো তাও নেই ।

এনাদের গানের একটা তুলনামূলক আলোচনা শুরু করার একটা ভাল জায়গা হল এনাদের এমন কোন গান বেছে নেওয়া যেখানে কোথাও একটা সাধারণ সূত্র আছে । সেরকম একটা গান হল সলিলের "পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী" আর রাহুলের "তুম মেরি জিন্দগীমে কুছ এইসি তরাহ সে আয়ে"। দুটি সুরই একই সুর থেকে অনুপ্রাণিত ।

প্রথমে শুনুন সলিলের "পল্লবিনী" । গানের প্রিলিউড থেকেই অ্যাকোর্ডিয়ান আর বঙ্গোর সঙ্গত গানের উচ্ছল মেজাজ তৈরি করে দেয় ।



রাহুল তাঁর গানটি ব্যবহার করলেন "বম্বে টু গোয়া" ছবির জন্যে । গানের শুরু হচ্ছে লতার হাল্কা হামিং দিয়ে । তৈরি করছে - যাকে বলে - "সফট রোমান্টিক" মেজাজ । (যে রেকর্ডিং শুনছেন, তার প্রথম গিটার লীড পরে যোগ করা ।)




প্রথম থেকেই গান দুটির মেজাজের তফাত স্পষ্ট । খুব তৈরি কান ছাড়া মিল খুঁজে পাওয়া দুরূহ । কিন্তু মূল সুর শুনলে মিল পরিষ্কার হয়ে যাবে । (একবার মূল সুরের সঙ্গে 'পল্লবিনী' গুনগুন করুন, দ্বিতীয়বার 'তুম মেরে' গুনগুন করুন । দুবারই খাপে খাপ মিলে যাবে ।) মূল সুরটি চার্লি চ্যাপলিনের লাইমলাইট ছবিতে ব্যবহার করা হয়, সম্ভবত: চ্যাপলিনের নিজের কম্পোজিশন । এবার শুনুন মূল সুরটি - 



মুক্তছন্দের মূল সুরকে সলিল ফেললেন ৪/৪ ছন্দে, ষোলমাত্রায় । রাহুল ফেললেন ৩/৪ ছন্দে পশ্চিমি ওয়াল্টজের চলন - যা গানটির সফট রোমান্টিক মেজাজ আনতে সাহায্য করছে । সুরকারদের এটা একটা প্রচলিত কায়দা - মূলের সুর মোটামুটি এক রেখে তাল-লয় বদলে গানের অবয়ব বদলে দেওয়া। আপাতভাবে সলিল সুরের বেশি কাছাকাছি মনে হবে। যদিও হয়তো তা নয়। সলিল বিদেশী পিসের প্রথম অংশকেই নিজের গানের প্রথম লাইনে ব্যবহার করেছেন। রাহুল ডালপালা ছেঁটে সেই সুরই ব্যবহার করলেন। এটও লক্ষ্যণীয় যে, সুরের চলনে যেটুকু বিদেশী গন্ধ আছে, যেমন কিছু অ্যাক্সিডেন্টাল নোটসের ব্যবহার, সেগুলো সলিল-রাহুল দুজনেই পরিহার করলেন।

আসলে এই দুই সুরকারই যখনই যেখানে নেবার মতন কোন মিউজিকাল এলিমেন্ট পেয়েছেন, তা সচ্ছন্দে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু নির্বিচারে নয়। নিজেদের মতন গড়ে-পিঠে নিয়ে ব্যবহার করেছেন। রাহুলের ক্ষেত্রে অভিযোগ যে বহু বিদেশি সুর তিনি "চুরি" করেছেন। এ অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই রাহুল প্রথম কয়েকটি বারের বেশি নেননি। এবং যে অংশ নিয়েছেন তাকেও নিজের মতন বদলে নিয়েছেন। সলিলও যখন মোৎজার্টের সিম্ফনির সুর ব্যবহার করছেন, তখনও কিন্ত ২/৪ কে পাঁচমাত্রা ফেলে এবং লয়ের পরিবর্তন করে অন্য রূপ দেবার চেষ্টা করছেন।

(চলবে)

শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০১০

আধুনিক এন আর আইদের করুণ উপাখ্যান

এই উপাখ্যানের নাম হতে পারত "অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়" অথবা "মডার্ন এন আর আই মে ভারত কিঁউ ছোড়া"। খুলেই বলি।

সে অনেকদিন আগে, জানেন, যখন আমি ইশকুল-টিশকুলে পড়তাম সেই সময় ছিল এন আর আইদের স্বর্ণযুগ। তখন তো আর এখনকার মতন পাড়ায় পাড়ায় এন আর আইয়ের চাষ হতনা। পাড়ায় এক পিস এন আর আই থাকলে পাড়ার ঘ্যামই বেড়ে যেত। শীতকালে এন আর আই পরিবার আসতেন, পাড়ার লোক কলার তুলে ঘুরে বেড়াত। অন্যপাড়ায় গিয়ে রেলা নিয়ে আসত। এন আর আই পরিবারের কর্তা জিনস পরে থলি হাতে বাজারে গিয়ে মহার্ঘ্য চিংড়িমাছ কিনতেন। এন আর আই গিন্নি টকটকে লিপস্টিক মেখে পার্ক স্ট্রীটের দোকান থেকে হাজার-দুহাজারের শাড়ি কিনে ননদ-ভাজদের ওয়ার্ল্ড ডর্ফে চীনে খাওয়াতেন। এন আর আই বাচ্চারা মিকিমাউস আঁকা জামা পরে ফুরফুরে ইংরিজিতে কথা বলত। সে এক দিন ছিল। কাছের লোকেরা বিকের ডট পেন পেত, আরও কাছের লোকেরা শার্ট প্যান্ট আর একদম নিজের প্রাণের লোকেদের জন্যে ঘড়ি ক্যামেরা। বাকিদের জন্যে লরির পেছনের আপ্তবাক্য "বুরি নজরওয়ালে তেরাহ মুহ কালা'। যে লোক দেশে থাকতে কোনদিন কথা বলেনি, সেই গায়ে পড়ে, "কি রে ভোম্বল কেমন আছিস? একদিন আসিস না, তোর জ্যাঠাইমা তো তোর কথা প্রায়ই বলে" বলে খেজুর করত। যে মেয়ে জীবনে কোনদিন পাত্তা দেয়নি, নাক ঘুরিয়ে চলে যেত, সেও বাপের বাড়ি এসে "ওমা ভোম্বলদা, কত ফর্সা হয়ে গেছ" বলে খুচরো বিলকিছিলকি ফ্লার্ট করত। ভোম্বলদা রোদ্দুরের দিকে মুখ করিয়ে পোলারয়েড ক্যামেরায় আত্মীয়-স্বজনের ছবি তুলতেন। তিরিশ গোনার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার তলা নিয়ে সড়াত্ করে ছবি বেরিয়ে আসত। পাড়ার লোক অবাক হয়ে চেয়ে দেখত। চালু হত নতুন নাগরিক প্রবাদের। উফ, সে এক উজ্জ্বল সোনালী দিন ছিল এন আর আইদের।

আমরা গল্প শুনতাম। আর ভাবতাম। স্কুলে যখন রচনা লিখতে দিত "তুমি বড় হয়ে কি হবে", লিখতাম বড় হয়ে হয়ে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক হব, বিনিপয়সায় গরীবঘরের ছেলেমেয়েদের পড়াব। দেশ গড়ব। মনে মনে ভাবতাম এন আর আই হব।

তারপরে একদিন এন আর আই হলাম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। টিউশনির টাকায় জিআরই-টোয়েফল, বাবার টাকায় ৩৫ ডলার করে অ্যাডমিশন ফি। হো চি মিন সরণিতে লাইন। ধার করে সস্তার প্লেনের টিকিট। দু-বছরের কৃছস্রাধন। চাকরি। ধারশোধ। গাড়িকেনা। আবার ধার। চক্রবত্ পরিবর্তন্তে দুখানি চ। একখানি চ হল চক্রবৃদ্ধিহারে ধার। অন্যখানি চ - চাকরি যাবার চিন্তা।

এন আর আই হয়ে কি দেখিলাম সেলুকাস? সেলুকাস জবাব দিল, "তোমার দিন গিয়াছে এন আর আই। নিজভূমে পরবাসী হইয়া ঘ্যাম লইতে গিয়াছিলে। এখন তোমার একূল-ওকূল দুকূলই গেল। ওদিকে পরভূমে নিজবাসী হইবার চক্কর অতি প্যাঁচালো। গ্রীন কার্ডের লাইন এখন দীর্ঘ পাঁচবছর লম্বা। অ্যাপ্লিকেশানে হেয়ার লিখিয়াছিলে 'ব্ল্যাক'। গ্রীন কার্ড যদি কখনও হস্তগত হয়, হেয়ারের স্থানে লিখিতে হইবে "নান'। এই তো লাইফ।"

ওদিকে বাত্সরিক ফাঁট দেখানোর খরচ সাত-আট হাজার টাকা। চারজনের প্লেনের টিকিটই পাঁচ। বাকি টাকায় ওখানে ফাঁটও তেমন দেখানো যায় না। দেখাব কি মশাই, ওয়ালমার্টে কেনা র‍্যাংলার জিন্স পরে বাজার করতে গিয়ে দেখি মাছওলা ব্যানানা রিপাব্লিক পরে মাছ বেচছে। তার শালা এন আর আই। দাগাটা সামলে দরদাম করতে গিয়ে হ্যাটা হলাম। পাশ দিয়ে হাঁটুর বয়েসি সেকটর ফাইভ স্যান্ট্রো চালিয়ে এসে এসে দই খেয়ে চলে গেল। হাতে রইল থলি।

বাকি যে দুর্গ ছিল, ফান্ডা, তাতেও মৌরসী পাট্টা নাই। বন্ধুকে ওবামা সম্পর্কে নিজের অন্তর্দৃষ্টির হকিকত্ বাতলাতে গিয়ে বন্ধুর বন্ধুর থেকে শুনে এলাম ওবামা, অ্যামেরিকান ইলেকশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স সহজে পাবার উপায়, নর্থ ডাকোটার আবহাওয়া, রোড আইল্যান্ডের পাবলিক ট্র্যাসপোর্টেশন থেকে কেজান কুইজিনের নাড়িনক্ষত্র। তিনি অ্যামেরিকা বিশেষজ্ঞ। তিনমাস ছিলেন। ওক্লাহোমায়। খাপ খোলার কোনরকম চান্সই নেই। তার ওপর পাঁচমিনিট আগেই তিনি ভিড় চৌরঙ্গিতে এমনি এমনি চারবার এপার ওপার করে সাইকোলজিকাল ওয়্যারফেয়ারের পয়লা রাউন্ড হ্যান্ডস-ডাউন জিতেছেন। আমি তখন গাড়ির স্রোতে ভ্যাবাচ্যাকা। অলরেডি দুবার মুটের "এই খবর্দা-আ-র' খেয়েছি। আবার বেশি ট্যাঁফোঁ করলে ভিড় প্রাইভেট বাসে উঠে আমাকে সাইকোলজিকালি একেবারে নিষ্পেষিত করে দেবেন বলে ভয় দেখিয়ে রেখেছেন।

কি বলব দাদা, এই এন আর আই জীবনে ঘেন্না ধরে গেল। দাও ফিরে সেই অরণ্য, লও এ নগর। এখন সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের রচনা লিখতে শেখাই, "হোয়েন আই গ্রো আপ, আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক টু মাই পেরেন্টস কান্টি ইন্ডিয়া অ্যান্ড বিকাম এন ইন্ডিয়ান"।

[২০শে এপ্রিল, ২০০৮ guruchandali.com]

সোমবার, ১৪ জুন, ২০১০

মোগলাই সাহেবসুবো

বেশ কয়েকবার বইটা শেল্ফে দেখেছি । এয়ারপোর্টের বইয়ের দোকানে, ব্যাঙ্গালোরের বইয়ের দোকানে, পাড়ার লাইব্রেরিতে, অফিসের লাইব্রেরিতে । একবার ব্লার্বে novel কথাটা চোখে পড়ায়, উল্টেপাল্টে দেখার ইচ্ছে হয়নি । অত মোটা ইংরিজি প্রেমের উপন্যাস পড়ার আকর্ষণ আমার কোনদিনই ছিল না । শেষ পর্যন্ত, অফিসের লাইব্রেরিতে পড়ার মতন কোন বই না পেয়ে একরকম বাধ্য হয়েই নিয়েছিলাম White Mughals । লেখক, William Dalrymple । মোটকা বই । পরে দেখেছি শেষের Glossary, Bibliography, Index বাদ দিয়ে উপাখ্যান শেষ হয় ৫০১ পাতায় ।

উপন্যাস নয় । ইতিহাস । অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের ক'বছর থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ক'বছর হল মূল কাহিনীর সময়সীমা । তবে খেইয়ের সুতো শুরু হয়েছে তার অনেক আগে, শেষ হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে । ইতিহাসের নায়ক জেমস কার্কপ্যাট্রিক । হায়দ্রাবাদে নিজমের দরবারের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট । নায়িকা হায়দ্রাবাদের অভিজাত পরিবারের ইরাণী বংশোদ্ভুত মেয়ে খয়েরউন্নিসা । এদের প্রেমকে ঘিরে যে ইতিহাসের জাল বুনেছেন তাতে কে নেই ! আছেন নিজাম ও তার প্রধানমন্ত্রী; হায়দ্রাবাদের ইরাণী বংশোদ্ভুত অভিজাত পরিবার; লর্ড কর্নওয়ালিস, জন শোর, লর্ড ওয়েলেসলি; মারাঠা পেশোয়া; টিপু সুলতান ...

অসম্ভব পরিশ্রমের কাজ । দীর্ঘ অধ্যবসায়ে বিভিন্ন মহাফেজখানা ঘুরে, লন্ডন-দিল্লি-হায়দ্রাবাদ ঘুরে খুঁটে খুঁটে সংগ্রহ করা তথ্য জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে গল্পের যে গালিচা বুনেছেন তার তুল্য ইতিহাস আমি অন্ততঃ পড়িনি । আর লেখার এমনই গুণ, চরিত্র আর ঘটনাগুলো চোখে দেখা যায় । এই "চোখে দেখা যায়" শব্দবন্ধটি এত ব্যবহৃত হয় যে এ দিয়ে আর ঠিক মনের ভাব প্রকাশ করা যায়না বটে, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনভাবে অনুভবটা ঠিক প্রকাশ করা যেত না । চোখে দেখানো ছাড়াও যে আবহ (উর্দুতে কী যেন বলে, মাহোল? সংস্কৃতে বাতাবরণ? বাংলায়?) তৈরী করেছেন, সেটা কোন ঐতিহাসিক নয়, ঔপন্যাসিকের উপযুক্ত কাজ । কেয়াবাত !!

বুধবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

Unicode, Unicode

ইউনিকোডে লেখার প্রচেষ্টা করছি | যদি পাঠকের মেশিনে কোন ইউনিকোড ফন্ট বসানো থাকে, তাহলে এই লেখা বাংলায় দেখতে না পাবার কোন কারণ নেই | তবে অক্ষরের ছাঁদ কিরকম হবে, সেটা নির্ভর করছে পাঠকের মেশিনে কোন ইউনিকোড ফন্ট বসানো আছে তার ওপর | যদি একাধিক ইউনিকোড ফন্ট থাকে, তাহলে দেখতে হবে ডিফল্ট ইউনিকোড ফন্ট  কোনটা | মাইক্রোসফট বৃন্দা নামের একটা ইউনিকোড ফন্ট ডিফল্ট হিসেবে দেয় | বেশ বাজে দেখতে | এনকোডিং-এও কিছু গড়বড় আছে মনে হয় | এককভাবে খন্ড-ত (ৎ) লেখা যায়না | বাংলার সবথেকে পপুলার ইউনিকোড ফন্ট সোলেইমানলিপিতেও একই অসুবিধে লক্ষ্য করছি | আর একটু ঘাটাঘাঁটি করতে হবে | তবে ফ্রি-স্যান্স, ফ্রি-সেরিফ কি একুশে দুর্গা বা ব্যাঞ্জন রূপালী ইত্যাদি ফন্টে সেই সমস্যা নেই | আশা করছি, দিন কয়েকের মধ্যে এ ব্যাপারে আরও কিছু ফান্ডা করতে পারব | বঙ্গলিপির ইউনিকোড সাপোর্ট ইমপ্লিমেন্ট করতে গিয়ে প্রচুর শেখা হচ্ছে |

রবিবার, ২৫ মে, ২০০৮

তিন পাহাড়ের গান

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা প্রথম পড়ি বোধহয় যখন আমি স্কুলে কি কলেজে পড়ি । অল্প বয়েসের কাঁচা মনে খুবই দাগ কেটেছিল । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোনদিন ডাকসাইটে কবি ছিলেন না । জীবনানন্দ, বিষ্ঞু দে অথবা শক্তি-সুনীলের সঙ্গে একসঙ্গে কখনই ওনার নাম বলা হত না । অথচ ওরকম একক ও বলিষ্ঠ স্বর আমি বোধহয় আর কারও কবিতায় পাইনি । ঐ একই সময়ে স্কুল অফ পীপলস আর্টের একটা ক্যাসেট হাতে আসে । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পাঠ আর সুর দিয়ে গান । সুর করেছিলেন বিনয় চক্রবর্তী । অসামান্য কাজ । কবিতার বই আর এই ক্যাসেট - দুয়ে মিলে বীরেন চাটুজ্জে আমার মধ্যে জেঁকে বসছিলেন ।




খুব ভাল লেগেছিল 'তিন পাহাড়ের গান' কবিতাটা । "পাহাড়িয়া মধুপুর মেঠো ধূলিপথ / দিনশেষে বৈকালী মিষ্টি শপথ" । অসম্ভব প্রাণবন্ত চিত্রকল্প । এসময়ে আমি নিজেও টুকটাক সুর-টুর করতে আরম্ভ করেছি । তো এই "তিন পাহাড়ের গান"-এও সুর করি এই সময়ে । পুরোটা নয় । কবিতাটা আরও লম্বা । কিন্তু যেখানে মনে হয়েছিল গান শেষ হওয়া উচিত, সেই অব্দিই সুর করেছিলাম । সেটা বোধহয় ১৯৮৮-৮৯ সাল । নিজের জন্যে করা, নিজের কাছেই রাখা ছিল । কাউকে শোনানো হয়নি । তার প্রায় বছর বারো-চোদ্দ পরে পারমিতার উৎসাহে ও প্ররোচনায় একে ওকে শোনাই । তারও পরে, ২০০৭ সালে এসে অ্যারেঞ্জ করি গানটা । এই সেই গান ।