শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০১০

আধুনিক এন আর আইদের করুণ উপাখ্যান

এই উপাখ্যানের নাম হতে পারত "অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়" অথবা "মডার্ন এন আর আই মে ভারত কিঁউ ছোড়া"। খুলেই বলি।

সে অনেকদিন আগে, জানেন, যখন আমি ইশকুল-টিশকুলে পড়তাম সেই সময় ছিল এন আর আইদের স্বর্ণযুগ। তখন তো আর এখনকার মতন পাড়ায় পাড়ায় এন আর আইয়ের চাষ হতনা। পাড়ায় এক পিস এন আর আই থাকলে পাড়ার ঘ্যামই বেড়ে যেত। শীতকালে এন আর আই পরিবার আসতেন, পাড়ার লোক কলার তুলে ঘুরে বেড়াত। অন্যপাড়ায় গিয়ে রেলা নিয়ে আসত। এন আর আই পরিবারের কর্তা জিনস পরে থলি হাতে বাজারে গিয়ে মহার্ঘ্য চিংড়িমাছ কিনতেন। এন আর আই গিন্নি টকটকে লিপস্টিক মেখে পার্ক স্ট্রীটের দোকান থেকে হাজার-দুহাজারের শাড়ি কিনে ননদ-ভাজদের ওয়ার্ল্ড ডর্ফে চীনে খাওয়াতেন। এন আর আই বাচ্চারা মিকিমাউস আঁকা জামা পরে ফুরফুরে ইংরিজিতে কথা বলত। সে এক দিন ছিল। কাছের লোকেরা বিকের ডট পেন পেত, আরও কাছের লোকেরা শার্ট প্যান্ট আর একদম নিজের প্রাণের লোকেদের জন্যে ঘড়ি ক্যামেরা। বাকিদের জন্যে লরির পেছনের আপ্তবাক্য "বুরি নজরওয়ালে তেরাহ মুহ কালা'। যে লোক দেশে থাকতে কোনদিন কথা বলেনি, সেই গায়ে পড়ে, "কি রে ভোম্বল কেমন আছিস? একদিন আসিস না, তোর জ্যাঠাইমা তো তোর কথা প্রায়ই বলে" বলে খেজুর করত। যে মেয়ে জীবনে কোনদিন পাত্তা দেয়নি, নাক ঘুরিয়ে চলে যেত, সেও বাপের বাড়ি এসে "ওমা ভোম্বলদা, কত ফর্সা হয়ে গেছ" বলে খুচরো বিলকিছিলকি ফ্লার্ট করত। ভোম্বলদা রোদ্দুরের দিকে মুখ করিয়ে পোলারয়েড ক্যামেরায় আত্মীয়-স্বজনের ছবি তুলতেন। তিরিশ গোনার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার তলা নিয়ে সড়াত্ করে ছবি বেরিয়ে আসত। পাড়ার লোক অবাক হয়ে চেয়ে দেখত। চালু হত নতুন নাগরিক প্রবাদের। উফ, সে এক উজ্জ্বল সোনালী দিন ছিল এন আর আইদের।

আমরা গল্প শুনতাম। আর ভাবতাম। স্কুলে যখন রচনা লিখতে দিত "তুমি বড় হয়ে কি হবে", লিখতাম বড় হয়ে হয়ে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক হব, বিনিপয়সায় গরীবঘরের ছেলেমেয়েদের পড়াব। দেশ গড়ব। মনে মনে ভাবতাম এন আর আই হব।

তারপরে একদিন এন আর আই হলাম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। টিউশনির টাকায় জিআরই-টোয়েফল, বাবার টাকায় ৩৫ ডলার করে অ্যাডমিশন ফি। হো চি মিন সরণিতে লাইন। ধার করে সস্তার প্লেনের টিকিট। দু-বছরের কৃছস্রাধন। চাকরি। ধারশোধ। গাড়িকেনা। আবার ধার। চক্রবত্ পরিবর্তন্তে দুখানি চ। একখানি চ হল চক্রবৃদ্ধিহারে ধার। অন্যখানি চ - চাকরি যাবার চিন্তা।

এন আর আই হয়ে কি দেখিলাম সেলুকাস? সেলুকাস জবাব দিল, "তোমার দিন গিয়াছে এন আর আই। নিজভূমে পরবাসী হইয়া ঘ্যাম লইতে গিয়াছিলে। এখন তোমার একূল-ওকূল দুকূলই গেল। ওদিকে পরভূমে নিজবাসী হইবার চক্কর অতি প্যাঁচালো। গ্রীন কার্ডের লাইন এখন দীর্ঘ পাঁচবছর লম্বা। অ্যাপ্লিকেশানে হেয়ার লিখিয়াছিলে 'ব্ল্যাক'। গ্রীন কার্ড যদি কখনও হস্তগত হয়, হেয়ারের স্থানে লিখিতে হইবে "নান'। এই তো লাইফ।"

ওদিকে বাত্সরিক ফাঁট দেখানোর খরচ সাত-আট হাজার টাকা। চারজনের প্লেনের টিকিটই পাঁচ। বাকি টাকায় ওখানে ফাঁটও তেমন দেখানো যায় না। দেখাব কি মশাই, ওয়ালমার্টে কেনা র‍্যাংলার জিন্স পরে বাজার করতে গিয়ে দেখি মাছওলা ব্যানানা রিপাব্লিক পরে মাছ বেচছে। তার শালা এন আর আই। দাগাটা সামলে দরদাম করতে গিয়ে হ্যাটা হলাম। পাশ দিয়ে হাঁটুর বয়েসি সেকটর ফাইভ স্যান্ট্রো চালিয়ে এসে এসে দই খেয়ে চলে গেল। হাতে রইল থলি।

বাকি যে দুর্গ ছিল, ফান্ডা, তাতেও মৌরসী পাট্টা নাই। বন্ধুকে ওবামা সম্পর্কে নিজের অন্তর্দৃষ্টির হকিকত্ বাতলাতে গিয়ে বন্ধুর বন্ধুর থেকে শুনে এলাম ওবামা, অ্যামেরিকান ইলেকশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স সহজে পাবার উপায়, নর্থ ডাকোটার আবহাওয়া, রোড আইল্যান্ডের পাবলিক ট্র্যাসপোর্টেশন থেকে কেজান কুইজিনের নাড়িনক্ষত্র। তিনি অ্যামেরিকা বিশেষজ্ঞ। তিনমাস ছিলেন। ওক্লাহোমায়। খাপ খোলার কোনরকম চান্সই নেই। তার ওপর পাঁচমিনিট আগেই তিনি ভিড় চৌরঙ্গিতে এমনি এমনি চারবার এপার ওপার করে সাইকোলজিকাল ওয়্যারফেয়ারের পয়লা রাউন্ড হ্যান্ডস-ডাউন জিতেছেন। আমি তখন গাড়ির স্রোতে ভ্যাবাচ্যাকা। অলরেডি দুবার মুটের "এই খবর্দা-আ-র' খেয়েছি। আবার বেশি ট্যাঁফোঁ করলে ভিড় প্রাইভেট বাসে উঠে আমাকে সাইকোলজিকালি একেবারে নিষ্পেষিত করে দেবেন বলে ভয় দেখিয়ে রেখেছেন।

কি বলব দাদা, এই এন আর আই জীবনে ঘেন্না ধরে গেল। দাও ফিরে সেই অরণ্য, লও এ নগর। এখন সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের রচনা লিখতে শেখাই, "হোয়েন আই গ্রো আপ, আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক টু মাই পেরেন্টস কান্টি ইন্ডিয়া অ্যান্ড বিকাম এন ইন্ডিয়ান"।

[২০শে এপ্রিল, ২০০৮ guruchandali.com]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন