tag:blogger.com,1999:blog-47859021817014576482024-03-13T15:11:18.955-07:00অতিকথনবাচালের স্বগতোক্তিUnknownnoreply@blogger.comBlogger19125tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-55261211015203174432016-07-01T00:13:00.003-07:002016-07-01T00:13:51.249-07:00আয়না, ঝর্ণা ও রাহুল<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
চার-পাঁচ বছরের স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়। নেইও। তাও হঠাৎ স্মৃতির
দু-চারটে ঝলক চলে আসে। সেইরকম কিছু ঝলক থেকে হয়ত বানিয়ে বানিয়ে পোক্ত
স্মৃতি বানিয়ে নিয়েছি। সেইরকমই গানের স্মৃতি। ছেলেবেলার, মানে ওই বয়েসের,
গান-সম্বন্ধীয় মাত্র দুটো স্মৃতি আছে আমার।<br />
<br />
একটা হল, আমাদের
আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়ির রান্নাঘরে পা ঝুলিয়ে বসে আছি আর বাইরে মাইকে
বাজছে "কাঞ্চি রে কাঞ্চি রে, প্রীত মেরি সচ্চি"।<br />
<br />
দ্বিতীয় স্মৃতিটা মজার। পিশতুতো ভাইবোনেরা এসেছে ছুটিতে। বাংলায় স্নো-হোয়াইট নাটক করা হচ্ছে। সত্যেন দত্তর <span class="text_exposed_show">একটা কবিতা আছে - </span><br />
<br />
<div class="text_exposed_show">
ঝর্ণা, ঝর্ণা, সুন্দরী ঝর্ণা।<br /> তরলিত চন্দ্রিকা <br /> চন্দন-বর্ণা।।<br />
<br />
এর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে স্নো-হোয়াইটের জন্যে সেজকাকাই বোধহয় লিখে দিলেন -<br />
<br />
আয়না, আয়না, সুন্দরী আয়না<br /> সব থেকে সুন্দরী<br /> কে আমায় বলনা।<br />
<br />
মনে আছে, এটা আমরা গলা ছেড়ে একটা মিষ্টি সুরে গাইতাম। সুরটা এতই মিষ্টি আর সোজা যে সেটাকে অনেকদিন বয়ে বেড়াতে পেরেছি।<br />
<br />
এর অনেকদিন পরে, ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি বোধহয়, একদিন চিত্রহারে হঠাৎ একটা
গান শুনে চমকে উঠলাম। আরে, এই তো সে আয়নার গান। ওরফে ঝর্ণার গান।
কিশোরকুমার গাইছেন -<br />
<br />
রোনা, কভি নহি রোনা<br /> চাহে টুট যায়ে<br /> কোই খিলোনা।<br />
<br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe width="320" height="266" class="YOUTUBE-iframe-video" data-thumbnail-src="https://i.ytimg.com/vi/TGEQ__EWcKg/0.jpg" src="https://www.youtube.com/embed/TGEQ__EWcKg?feature=player_embedded" frameborder="0" allowfullscreen></iframe></div>
<br />
<br />
সুরটা শুনে দেখুন। তারপরে সেই সুরে "ঝর্ণা, সুন্দরী ঝর্ণা" গান, দেখবেন খাপে খাপ মিলে গেছে।<br />
<br />
কিন্তু সেটা কথা নয়। কথা হল, ছেলেবেলার যে গান মনে রয়ে গেল, বোধহয়
অবচেতনেই, সে গানদুটোই গেয়েছিলেন কিশোরকুমার আর, মনে হয় তার চেয়েও
গুরুত্বপূর্ণ, দুটোই সুর করেছিলেন রাহুল দেব বর্মণ।<br />
<br />
সায়েবরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন শিশু, মানে একেবারে কয়েকমাসের শিশুদের ওপর মোৎজার্টের সঙ্গীতের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আছে।<br />
<br />
তবে কি রাহুলেরও আছে?</div>
</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-91926921801771307832016-06-24T22:03:00.001-07:002016-06-24T22:03:11.451-07:00বাংলা স্কুল<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
ছ বছর বাংলা বয়েজে পড়ে যখন বাংলা কো-এডে ভর্তি হলাম তখন আমি নেহাতই
আনকোরা। একেবারে গ্রীন। প্রথম দিনই ক্লাসের বাঘা বাঘা ছেলেরা ইন্টারভিউ
নিল। কোন স্কুল থেকে এসেছি, ক্লাসে কটা মেয়ে ছিল, নিরোধ কি, সত্যম শিবম
সুন্দরম দেখেছি কিনা - এইসব। তারপরে গালাগালির ইন্টারভিউ। সে সব তো পাশ করে
গেলাম। টিফিনের সময়ে লাইব্রেরির সামনের মাঠে রবারের বলের ফুটবল দলে চান্সও
পেয়ে গেলাম। কো-এড ইশকুলের জীবন শুরু হয়ে গেল। সত্যি বলতে কি বয়েজ স্কুল
আর কো-এড স্কুলের পার্থক্য কখনই প্রকট হয়নি।<br />
<br />
তবে জাগতিক ব্যাপারে
একেবারে উদোমাদাচন্ডীচরণ ছিলাম না। বার্ডস-অ্যান্ড-দ্য-বীজ সম্বন্ধে
সবাইকারই জানাশোনা ছিল। তবে তার থেকে অনেক বেশি মুখরোচক ছিল গাভাসকার-বিদেশ
বসু-এন্টার-দ্য-ড্রাগন। আর ছিলেন মিস্টার বচ্চন। 'অনুসন্ধান' এসে গেছে,
'শান' আসব-আসব করছে। বহু ছেলে 'আমি বলছিলাম কি' বলে অনুসন্ধান-স্টাইলে কথা
বলা শুরু করছে। এসে গেছে সুখেন দাসের অমর ছবি 'প্রতিশোধ'। চিত্রমালায়
দেখেছি বাস-থেকে লাফিয়ে ধানক্ষেতে নেবেই সুখেন দাস গান ধরেছেন 'হয়ত আমাকে
কারো মনে নেই'। মাইকে বাজছে 'ইয়াম্মা ইয়াম্মা'।<br />
<br />
মেয়েরাও ছিল।
পেরিফেরাল ভিশনে। ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব হল অনেক পরে।
সেভেন-এইট অব্দি ছিল মূলতঃ ঝগড়ার সম্পর্ক। অরূপের বাবা পুলিশে কাজ করতেন।
পুলিশি ঐতিহ্যে অরূপ সারাটা স্কুল-জীবন অ্যায়সা মোটা সোলের সবুজ ক্যানভাসের
জুতো পরে এল। সেই জুতো পরে অরূপের ফুটবল খেলা বারণ ছিল। চার্জ করা যেত না।
ক্লাস সেভেনে একবার সঙ্ঘমিত্রার সঙ্গে অরূপের ঝগড়া লাগল। ঝগড়া থেকে
লাথালাথি। ওই জুতো পরে। আমরা ছেলেরা অরূপকে উৎসাহ দিলাম। মেয়েরা
সঙ্ঘমিত্রাকে। তারপরে ভুলে গেলাম।<br />
<br />
দুপুরে সবদিন ফুটবল খেলা যেত না।
বল থাকত না বা মাঠ পাওয়া যেত না। সেসব দিন আমরা কিং-কিং বা চোর-পুলিশ
খেলতাম। চোর-পুলিশ হলে পেছনের অডিটোরিয়ামের ছাতে। সিঁড়ির ভাঙা কাঁচের জানলা
দিয়ে গলে। সেই ছাতেই ছিল স্কুলের জলের ট্যাংক। শৈবাল একদিন ট্যাংকে হিসি
করে দিল। আমরা পরের সাতদিন কেউ স্কুলে জল খেলাম না। খুব তেষ্টা পেলে সামনে
বারিকদের বাড়ির প্যাসেজের কল থেকে গিয়ে জল খেয়ে আসতাম। স্কুলের বাকি কেউ
জানত না। অন্যরা হুহা সেই জলই খেল। স্টুডেন্ট-টীচার-হেডু সবাই।<br />
<br />
এই করতে করতে একদিন হঠাৎ দেখি, বড় হয়ে গেছি।</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-29196750993347091812016-06-22T21:45:00.002-07:002016-06-22T21:45:38.619-07:00ফেলুদা<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
তখন বছর-বছর পুজোসংখ্যা দেশে বেরোত ফেলুদা আর আনন্দমেলায় প্রফেসর শঙ্কু।
সে সময়ে এখনকার মতন গরম থাকতে থাকতে পুজোসংখ্যা বেরিয়ে যেত না। বেরোত
মহালয়ার আশেপাশে সময়ে। একবছর হা-পিত্যেশ করে থাকার পরে যখন দেশ বাড়িতে এল,
দেখি ভো কাট্টা। নো ফেলুদা। কোন সাল সেটা? ৮০? ৮২? সেবার ফেলুদা বেরোল
সন্দেশ পুজোসংখ্যায়। হত্যাপুরী। শুরুটাও অন্য ফেলুদার থেকে আলাদা। "ডংলুর
কথা" দিয়ে। তারপর থেকে সেটাই রেওয়াজ হয়ে গেল। একবার দেশ পুজোসংখ্যায়
ফেলুদা, আরেকবার সন্দেশে।<br />
<br />
এর আগে সন্দেশে ফেলুদার দারুণ সব গল্প বের<span class="text_exposed_show">িয়েছে।
প্রথম ফেলুদা "ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি"-ই তো সন্দেশে। "ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা",
"গোঁসাইপুর সরগরম", "সমাদ্দারের চাবি" - এ সবই সন্দেশে। তবে পুজোসংখ্যায় নয়
বোধহয়। প্রোফেসর শঙ্কুও সন্দেশে শুরু। "একশৃঙ্গ অভিযান" মনে আছে সন্দেশে
ধারাবাহিক বেরিয়েছিল। আমি পরে বাড়ির বাঁধান সন্দেশে পড়ি।</span><br />
<br />
<div class="text_exposed_show">
আজ হঠাৎ ইউটিউবে "গোঁসাইপুর সরগরম" দেখে মনে পড়ল এইসব। ফেলুদার গল্পে
ডিটেকশন তো খুব স্ট্রং থাকত না। তাও সন্দেশের ওই "ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা",
"গোঁসাইপুর সরগরম", "সমাদ্দারের চাবি" ইত্যাদিগুলোতেই যা একটু ডিটেকশন
পাওয়া যেত। আর এগুলোর পটভূমিকাও মফস্বলি বাংলা বা গ্রাম বাংলা। সত্যজিৎ
দু-চার কথায় সেটারও মাহোল যেরকম তৈরি করতেন, আমার খুব ভাল লাগত। একবার
লিখেছিলেন, "কলকাতার বাইরে এলেই কীরকম ঝপ করে সন্ধ্যে নেবে যায়!" বা
"কলকাতা থেকে বেরলেই সবুজ দেখে চোখের আরাম হয়।" - অবশ্যই প্যারাফ্রেজ করে
লিখলাম। বাকি সবও স্মৃতি থেকে আন্দাজিফিকেশন।<br />
<br />
এখন আর ফেলুদা পড়তে ভাল লাগে না। কিন্তু ফেলুদা পড়ার ছেলেবেলার স্মৃতি ভাবতে এখনও ভাল লাগে।</div>
</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-40534640821758462762016-06-22T21:44:00.002-07:002016-06-22T21:44:39.494-07:00ধনেশ পাখি<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
এটা না বললেই নয়। এর আগে অন্যত্রও একবার বলেছি।<br />
<br />
আমাদের সঙ্গে
কলেজে পড়ত অসীম। অসীম দাস। সত্যি নামটা বলছি না। অসম্ভব আমুদে ছেলে। এবং
কালারফুল। সেইসঙ্গে দারুণ হাজির-জবাবের ক্ষমতা। আর ছিল মজার-মজার এবং
ইনোভেটিভ গালাগালির অফুরন্ত স্টক। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে মুজতবা আলী,
স্নেহাংশু আচার্য - এইসব দিকপালদের উত্তরসুরী সে। অসীম ছাড়া কোন আড্ডা,
বেড়াতে যাওয়া-টাওয়া ঠিকমতন জমত না। কলেজে একদিন না এলে ফাঁকা-ফাঁকা লাগত।
কলেজের ফাইনাল ইয়ারে গোয়া বেড়াতে গিয়ে এক রাত্তিরে লাস্ট-বাস মিস করে ভ্যা<span class="text_exposed_show">গেটর
বিচ থেকে সাড়ে তিনঘন্টা হেঁটে ক্যালাঙ্গুটের ডর্মিটরিতে ফিরতে হয়েছিল
আমাদের জনা পনেরোকে। তার মধ্যে আদ্দেক রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজে। সেই পুরো
রাস্তাটা অসীম আর আমাদের আরেক বন্ধু নন-স্টপ গালাগালির কম্পিটিশন শোনাতে
শোনাতে নিয়ে এসেছিল। </span><br />
<br />
<div class="text_exposed_show">
অসীম
ছিল প্রেমিক। সম্ভব-অসম্ভব বিভিন্ন রকমের প্রেমে অতি দ্রুততার সঙ্গে পড়ে
যাওয়ায় অসীমের কোন জুড়ি ছিল না। কিন্তু সেগুলো সবই একতরফা। ফলে একটা প্রেমও
শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। হবে কী করে? বন্ধুদের কাছে অতি সরব হলেও, যেখানে
আসল কথাটি বলার - সেখানে একেবারে সাইলেন্ট। কিন্তু তার জন্যে অসীম যে
দেবদাস-পানা “আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে” হয়ে বসে থাকবে, সেরকম কোন সিনই
নেই। অত্যন্ত স্পোর্টিং প্রেমিক ছিল সে। আর ওইসব উচাটনও দিন কয়েকের মধ্যে
মানবমনের গভীরে বিলীয়মান হয়ে যেত।<br />
<br />
তো এমতাবস্থায় একদিন অসীম
চৈতালী (কাগজের ভাষায়, নাম পরিবর্তিত) বলে তাদের হাউজিং-এর একটি মেয়ের
প্রেমে পড়ল। পড়ল মানে একেবারে পড়েই রইল। আমরা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলেই
কম্পালসারিলি অসীমের প্রেমের প্রোগ্রেস রিপোর্ট শুনতাম আর নিজেদের
জ্ঞানবুদ্ধি মতন পরামর্শ দিতাম। যেমন অসীম বলল, 'আজ মাইরি হাউজিং-এ
ব্যাডমিন্টন খেলছিল চৈতালী। কতক্ষণ আর ডাইরেক্টলি ঝাড়ি করা যায়! তাই ছক করে
ওর ভাইকে ডেকে ধনেশ পাখি দেখালাম"। ধনেশ পাখি? বেহালার হাউজিং-এ? দেখিয়েছে
হয়তো চড়াই। অসীম বলল, "চৈতালীর ভাইকে বলার জন্যে এই নামটাই সবথেকে
অ্যাপ্রোপ্রিয়েট মনে হল।" একদিন হয়তো বলল, "একটা ছেলে শালা চৈতালীকে ছক
করছে। কী করা যায় বল তো?" অমুকে বলল, “বেনামী চিঠি দে।” একজন বলল,
“তক্কে-তক্কে থাক। একদিন বাসে দেখতে পেলে পকেটমার বলে কেলিয়ে দিবি।” এইরকম
চলছে।<br />
<br />
এক সেমেস্টার পরীক্ষার সকালে কলেজে গিয়ে দেখি অসীমের
মেজাজ পুরো বিলা। দেবদুলালীয় শোকবার্তা স্টাইলে ঘোষণা করল, "কাকা, আজ সব
শেষ।” “সে কী?” অসীমের বয়ানে - “সকালে শালা এমনিই মেজাজ খারাপ -
সেমেস্টারে ৩২ আস্কিং - বাজার থেকে ফিরছি, চৈতালীর বাপ ধরেছে। রোজই ধরে,
আর রোজই এক প্রশ্ন। কি অসীম, বাজার থেকে ফিরছ নাকি? বাঁ... দেখছ
সক্কালবেলা হাতে থলি, বাজার থেকে ফিরব না তো কি বেশ্যাবাড়ি থেকে ফিরব? তাও
চৈতালীর বাপ তো, গম্ভীর হয়ে বললাম, হ্যাঁ বাজার। তখন বলে কেমন বাজার হল?
বাজার আবার বালের কেমন হবে? বললাম, ভালোই। মাছ কিনেছো? হ্যাঁ। তখন জিগেস
করে, কী মাছ কিনলে। আমার বাঁ ... আজ অ্যায়সা মটকা গরম হয়ে গেল, বলে
দিয়েছি, বড় বড় তিমিমাছ কিনেছি। সস্তায় দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি যান। এখনও আছে।"</div>
</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-81829160300887465482016-06-13T22:00:00.000-07:002016-06-13T22:00:00.744-07:00নাট্যারম্ভ<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
আমি বহু বছর বিদেশে নাটক করেছি, বুঝলেন। বেশ সিরিয়াসলি। খাটাখাটনি
করেছি। কয়েকবার তো নিজেরা লিখে - একবার প্রায় ওয়ার্কশপের মতন করে। তার
সঙ্গে প্রতিবারই নিজেরা সেট ডিজাইন করেছি, বানিয়েছি; লাইট ডিজাইন করেছি;
মিউজিক বানিয়েছি-বাজিয়েছি-রেকর্ড করেছি ইত্যাদি। সঙ্গে তো অভিনয়, পরিচালনা
ইত্যাদি আছেই। আর আছে মার্কেটিং, টিকিট বিক্কিরির বিভীষিকা। সে এক, যাকে
বলে, বিশাল কর্মযজ্ঞ। এর সবই একেবারে শূন্য থেকে শিখতে হয়েছে। আমাদের মধ্যে
এর আগে সিরিয়াস নাট্যচর্চা করেছিল একমাত্র অমিতাভ (<a class="profileLink" data-hovercard="/ajax/hovercard/user.php?id=1666994935" href="https://www.facebook.com/amitava.baksy">Amitava Baksy</a>),
আর কিছুটা বোধহয় ইন্দ্রাণী। কিন্তু-কিন্তু করে এও বলি যে প্রোডাকশন
কোয়ালিটিও একেবারে দুচ্ছাই কিছু হতনা, কিছু ক্যাপটিভ অডিয়েন্সও তৈরি
হয়েছিল। এসবই হয়েছে কিছু সমমনস্ক, নাটুকে আর খাটতে-ও-শিখতে-ইচ্ছুক
নারী-পুরুষ এক সময়ে এক জায়গায় জড় হয়েছিলাম বলে।<br />
<br />
কিন্তু আমার নাটকের
জীবন দীর্ঘতর, সেটা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। এই সুদূরপ্রসারী নাট্যজীবন শুরু
হয়েছিল নামভূমিকায় অভিনয় দিয়ে। "গাধা-পিটিয়ে-মানুষ" নাটকে গাধা, "কালো
কুকুর" নাটকে কুকুর - নটসূর্য হবার দিকে এই ছিল যাত্রারম্ভ।<br />
<br />
এর বহু
পরে, কলেজে পড়াকালীন পাকামি ও আঁতলামির বিছে যখন কামড়াল তখন কয়েকজন বন্ধু
মিলে দল গড়ে নাটক করতে শুরু করলাম। একজনেরও পুজোর নাটকের বাইরে নাটক করার
কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। তাতে কি ডরাই কভু ভিখারী রাঘবে? বাংলায় কেউ নাটক
লিখতে পারে? ধুর ধুর। আমরা দেখিয়ে দেব। মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার।
একেবারে ইবসেন। Ghosts. অনুবাদ আছে না? আছে, কিন্তু ছ্যা ছ্যা, অন্যের
অনুবাদ নিবি কি রে! নিজেরা আনুবাদ কর। অভিজ্ঞতা তো নেইই, কনফিডেন্সও নেই।
তাই তিনবন্ধু একেক জন একেকটা অঙ্ক অনুবাদ করলাম। বাংলা সাহিত্যকে অকূল
পাথারে ভাসিয়ে সে অনুবাদ বা অনুবাদগুচ্ছ কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে যদিও।
বাঁচা গেছে। নইলে যে কী হত, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। দলের কারুর নাটকের
অভিজ্ঞতা ছিলনা বলে যে লিখেছি, সেটা ঠিক লিখিনি। টুকটুকির ছিল। দলের দুজনের মধ্যে অন্যতম মহিলা সদস্য। টুকটুকি অসম্ভব ভাল আবৃত্তিও করত, আজকাল যাকে বাচিক
শিল্প বলে।<br />
<br />
সে নাটক একেবারে টপ-টু-বটম ডিজাস্টার। দলের নাম
নৈর্ব্যক্তিক। আর্দ্ধেক লোক উচ্চারণই করতে পারল না। নাটকের নাম আবর্ত। আমার
কাকা বলেছিল, পাকামি কোরোনা। স্পিন বল দেবার আগে সোজা বল দিতে শেখ। কে
শোনে কার কথা! নাটকের আগে শ্যমাবাজারে গিয়ে মেকাপ আর সেটের বরাত দিয়ে এলাম।
"জমিদার বাড়ির সেট তো? হয়ে যাবে।" লাইটের বরাত পেল সল্ট লেকের বৈশাখীর
একজন। পাড়ার পুজোর নাটকে লাইট করেছিল। মানে দুদিকে দুটো লাইটের সামনে মুড
অনুযায়ী লাল-নীল কাগজ-ধরা। তাৎক্ষণিক। স্ক্রিপ্ট-টিপ্ট পড়ার কোন গল্প নেই।
নাটকের দিন মেকাপ আর লাইট এল। সেট আর এল না। লাইটের লোক বলল, "জমিদার বাড়ির
সেট করে দেব"? তাই সই। লোকের হাতে-পায়ে ধরে টিকিট বেচা হয়েছে। টিকিট তো
নয়, গেস্ট কার্ড। কারণ টিকিট হলে এন্টারটেনমেন্ট ট্যাক্স না কী একটা দিতে
হবে। সে ট্যাক্স মকুব করা মহা ঝামেলা। তো নাটক শুরু হবে সাতটায়। লোকজন
গুটিগুটি আসতে শুরু করেছে। সাড়ে ছ'টা নাগাদ লোডশেডিং হয়ে গেল। কুছ পরোয়া
নেহি। হলে জেনেরেটর আছে। চালাও জেনেরেটর। কিন্তু জেনেরেটরের লোক গলদঘর্ম
হয়ে গেল। জেনেরেটর আর চালু হয়না। ম্যানেজার এসে পড়লেন। সরকারী কর্মচারী।
নাটকের একটি মূল চরিত্র তাকে চমকাতে গিয়ে পুলিশের হুমকি খেল। সে একে
কেলেংকারিয়াস প্যান্ডেমোনিয়াম। শেষ অব্দি আলো এসে নাটক শুরু হল বোধহয় রাত
ন'টা নাগাদ। ততক্ষণে ষাট শতাংশ দর্শক - মানে যারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিংবা
আত্মীয় নয়, তারা পাতলা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস। কারণ সে যা নাটক হয়েছিল!<br />
<br />
এরপরেই বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে দলটির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। তবে
সত্যের খাতিরে এও বলে রাখা ভাল আমরা আরও একটি নাটকের মহড়া শুরু করেছিলাম।
সে নাটক আর মঞ্চস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। নাটক ও নাট্যকার খুব বেঁচে গেছেন।
আমরা তথৈবচ।</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-64440225729779200902016-06-10T10:52:00.001-07:002016-06-10T10:52:08.364-07:00মোটা<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
আমি ডাকি মোটা বলে। স্কুলে ছ'বছর, আর তারপরে কলেজে চারবছর একসঙ্গে
পড়েছি। তাছাড়া মোটারা থাকতও সল্ট লেকে খুবই কাছে। আমরা সিডি ব্লক, মোটারা
এবি ব্লক। কোণাকুণি দেখলে মাঝখানে একটা মাত্র ব্লকের ব্যবধান - বিসি। এই
নৈকট্য পরে খুব সুবিধে দিয়েছে।<br />
<br />
মোটার মতন বন্ধুবৎসল ছেলে খুব কম
দেখেছি। বন্ধুবৎসল এবং অসূয়াহীন। কম নয়, দেখিইনি। কলেজে অন্যরা ক্লাস করছে
না। এমনিই করছে না। মোটাকে ক্লাস করার জন্যে তারা ব্যাগড়াও দিয়েছে। তাও
মোটা ক্লাস করে যে শুধু নোট নিচ্ছে তাইই নয়, এক্সট্রা দুটো কার্বন কপিও নি<span class="text_exposed_show">চ্ছে। কোন বন্ধুর কখন কাজে লেগে যায়, কে জানে!</span><br />
<div class="text_exposed_show">
বাড়ি ফেরার মুখে মোটা বলল, "দশ টাকা দে।" দিয়ে দিলাম। পরের দিন মোটা কটা
খুচরো পয়সা আর একগাদা জেরক্স-করা পাতা দিল। স্যার কোন বইয়ের রেফারেন্স
দিয়েছেন। মোটা নিজের জন্যে কপি করছিল, অন্যরা বঞ্চিত হবে কেন? তাই নিজে
উপযাচক হয়ে সবাইকার জন্যে জেরক্স করে দিয়েছে। অনেকবার।<br />
<br />
মোটার দোষ
বলতে, মোটা ক্লাস করতে খুব ভালবাসত। শুধু ক্লাস করতেই নয়, মোটা পড়াশুনো
করতেই ভালবাসত। কলেজে, ক্লাসে মোটামুটি সবাই রাজী হয়েছে মাস কাট দিতে,
কিন্তু বেঁকে বসল মোটা আর রাজা। এরকম বহুবার হয়েছে যে ক্লাসে শুধু মোটা,
রাজা আর প্রফেসর। ক্লাসের বাকিরা ভিতর হতে বাহির হয়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল বাহিরে
গাছতলায় বসে কালাতিপাত করছে। পরে এই আমরাই ক্লাস টেস্টের আগের রাতে বা
এমনকি সেমেস্টার পরীক্ষার আগের রাতে মোটার বাড়িতে হানা দিয়েছি। মোটা নিজের
নোট দিয়ে দিয়েছে ব্যাকবেঞ্চারগুলোকে। আমার লাইব্রেরি কার্ড তো চারটি বছর
মোটার কাছেই গচ্ছিত ছিল। মোটাই আমার জন্যে বই তুলত, আমাকে পড়াবার ব্যর্থ
চেষ্টা করত, আবার ফেরত দিয়ে দিত।<br />
<br />
পরে ভেবে মনে হয়েছে মোটার
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া উচিত হয়নি। বাবার মতন পলিটিকাল সায়েন্স বা অন্য কোন
সোশ্যাল সায়েন্স পড়া ভাল হত। তবে সে তো এখন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করে
প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউটে পড়াচ্ছে আর হিল্লি-দিল্লি-বিলেত করে বেড়াচ্ছে। খান
চারেক বইও প্রকাশ করে ফেলেছে।<br />
<br />
মোটার যে গল্পটা ফোকলোর হয়ে গেছে,
সেটা বলি। ইশকুলের গল্প। ক্লাস ইলেভেন। মোটার গায়ে অমানুষিক শক্তি ছিল।
কিন্তু মুশকিল হল মোটা সেটা জানত না। এর ফলে অনেক ছেলে অকারণে আহত-টাহত
হয়েছে। সে যাক। ইলেভেনে, ক্লাসে সাত রো বেঞ্চির দ্বিতীয় সারিতে মোটা বসত।
একবার টিফিনের পরে মোটার প্যান্টের বেল্টের লুপে একটা মোটা নারকোল দড়ি দিয়ে
ল্যাজ করে দেওয়া হল। মোটা টের পায়নি। ল্যাজটা লম্বা। খুব লম্বা। এত লম্বা
যে তার অন্য দিকটা শেষ, মানে সাত নম্বর, সারিতে বেঞ্চির পায়ায় বেঁধে দেওয়া
হয়েছে। একদম মোরম্বা করে। আর সেই বেঞ্চিতে গাদাগাদি করে ছ'টা উঠতি জোয়ান
ছেলে বসে ক্লাস করছে। বেঞ্চি নড়ে যাবার কোন সিনই নেই। এরপর বিজয়াদি ক্লাসে
এসেছেন। এসে মোটাকে কিছু একটা জিগেস করেছেন। মোটা ক্লাসে জবাব-টবাব দিতে
খুব ভালবাসত। তো জবাব দেবে বলে উৎসাহভরে উঠতে গিয়ে মোটা ল্যাজে ঠেকে গেল।
উঠতে পারল না। তখনও বুঝতে পারেনি কিসে আটকাচ্ছে। আবার ওঠার চেষ্টা করল।
আবার আটকাল। তিন নম্বর বারের বার সর্বশক্তি দিয়ে মোটা উঠে দাঁড়া্তেই পেছনের
বেঞ্চির পায়াটি মোটার শক্তির কাছে পরাভূত হয়ে নিজের কাজে ইস্তফা দিল এবং
ছ'টি সা-জোয়ান ছেলে ভূমি নিল। এ জিনিস চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।<br />
<br />
মোটা, শুনছিস?</div>
</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-89375489637794679432016-06-07T13:26:00.000-07:002016-06-07T13:26:24.529-07:00সেবোনিয়ার<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
<div data-contents="true">
<div class="" data-block="true" data-editor="fn4la" data-offset-key="eaggd-0-0">
<div class="_1mf _1mj" data-offset-key="eaggd-0-0">
<span data-offset-key="eaggd-0-0"></span></div>
</div>
<div class="" data-block="true" data-editor="fn4la" data-offset-key="almij-0-0">
<div class="_1mf _1mj" data-offset-key="almij-0-0">
<div data-contents="true">
<div class="" data-block="true" data-editor="buur" data-offset-key="2sk5n-0-0">
<div class="_1mf _1mj" data-offset-key="2sk5n-0-0">
<span data-offset-key="2sk5n-0-0"><span data-text="true">সত্যজিৎ রায়ের একটা গল্পে হ্যামিলটনের মাঠ বাঙালি উচ্চারণে হামলাটুনির মাঠ হয়ে গেছিল। লেডি ক্যানিং থেকে লেডিকেনির নাম হওয়ার গল্প তো প্রায় সবাই জানেন, যদিও এখন সেই গল্প জিজ্ঞাসার চিহ্ণ পড়েছে। এছাড়া প্ল্যাটুন থেকে পল্টন, প্লায়ার্স থেকে প্লাস - এসব তো আছেই।</span></span></div>
</div>
<div class="" data-block="true" data-editor="buur" data-offset-key="eq8hg-0-0">
<div class="_1mf _1mj" data-offset-key="eq8hg-0-0">
<span data-offset-key="eq8hg-0-0"><br data-text="true" /></span></div>
</div>
<div class="" data-block="true" data-editor="buur" data-offset-key="am718-0-0">
<div class="_1mf _1mj" data-offset-key="am718-0-0">
<span data-offset-key="am718-0-0"><span data-text="true">আমাদের কলকাতার বাড়িতে একটা চেস্ট-অফ-ড্রয়ার আছে। তার নাম সেবোনিয়ার। পল্টনেও তাকে নড়াতে পারে না, এমনই ভারী। আমি তাকে জন্মাবধি দেখে আসছি। চারতলা দেরাজ, আমরা টানা বলতাম। প্রত্যেক তলায় একটা সাড়ে তিন-চার ফুটের গভীর ড্রয়ার। সব থেকে ওপরের তলায় তার আদ্ধেক-চওড়া দুটো ড্রয়ার। আজকালকার মতন ফ্যান্সি রেল লাগান ফঙ্গবেনে জিনিস নয়। একদম সলিড। এক-একটা দেরাজ টেনে বের করতে কালঘাম ছুটে যায়। গামা পালোয়ান না লাগলেও সে যার-তার কম্ম নয়। সে কী আর আজকের জিনিস? বহু পুরনো। বোধহয় ওম্মার বিয়ের যৌতুক। মানে আদি উনিশশো ব্রিটিশ সালের মাল। বার কয়েক পালিশ করা সত্বেও আবার সে প্রায় আবলুশ কাঠের মতন কালো হয়ে গেছে। ছোট থেকে জিনিসটাকে "সেবোনিয়ার" বলে ডাকতে শুনেছি। আর কারুর বাড়িতে "সেবোনিয়ার" আছে বলে কোনদিন শুনিনি। নামটায় কীরকম যেন ফ্রেঞ্চ-ফ্রেঞ্চ গন্ধ। আমি থোড়িই ফরাসি জানি! ওই গন্ধ অব্দিই দৌড়। কাজেই জিনিসটার সত্যিকারের যে কী নাম জানতে পারিনি। তারপরে ভুলেও গেছিলাম। সেদিন মনে পড়াতে সার্চ করতে গিয়ে দেখি কোন আন্দাজী বানানেই কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে ঘুরপথে খুঁজে পেলাম। ফ্রেঞ্চই। chiffoniere। সেখানে থেকে ব্রিটিশ বা মার্কিনি chiffonier বা chiffonnier। বাঙালি উচ্চারণে শিফনিয়ের থেকে কীভাবে যেন সেবোনিয়ার হয়ে গেছে। (আসল ছবি নেই।)</span></span></div>
</div>
</div>
</div>
<div class="_1mf _1mj" data-offset-key="almij-0-0">
</div>
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<a href="https://2.bp.blogspot.com/-rfwW4fJx4h0/V1ZthZKV6nI/AAAAAAAACvE/h-Amcq8dud0HHobEmx8xiKY0NDYve8M_ACLcB/s1600/Chiffonnier.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" height="240" src="https://2.bp.blogspot.com/-rfwW4fJx4h0/V1ZthZKV6nI/AAAAAAAACvE/h-Amcq8dud0HHobEmx8xiKY0NDYve8M_ACLcB/s320/Chiffonnier.jpg" width="320" /></a></div>
<div class="_1mf _1mj" data-offset-key="almij-0-0">
</div>
</div>
<div class="" data-block="true" data-editor="fn4la" data-offset-key="65drl-0-0">
<div class="_1mf _1mj" data-offset-key="65drl-0-0">
<span data-offset-key="65drl-0-0"><br data-text="true" /></span></div>
</div>
<div class="" data-block="true" data-editor="fn4la" data-offset-key="5j7dj-0-0">
<div class="_1mf _1mj" data-offset-key="5j7dj-0-0">
<span data-offset-key="5j7dj-0-0"><br data-text="true" /></span></div>
</div>
</div>
</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-75570733212547468822016-06-03T22:52:00.003-07:002016-06-03T22:52:37.195-07:00জগাদাদা<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
আমাদের বাড়িতে কাজ করত জগাদাদা। ঊড়িষ্যার লোক। কিশোর বয়সে কাজ করতে
এসেছিল কলকাতায়। সে আমার জন্মের ঢের আগে। তখন বাড়িভর্তি লোক। শুনেছি
জগাদাদা নাকি আমাদের বাড়িতেই চুরি করে ধরা পড়ে যায়। চাকরি গেছিল কিনা
জানিনা, কিন্তু যোগাযোগ যায়নি। "পুরাতন ভৃত্য" ট্র্যাডিশন। পরে বাবা কোথায়
কী কলকাঠি নেড়ে সরকারী অফিসে পিওনের চাকরি করে দেয় জগাদাদার।<br />
<br />
তারপর
থেকে মাঝে মাঝে, দু-চার মাস অন্তর, রোববার করে চলে আসত বেলা দশটা-এগারোটা
নাগাদ। কাজ-টাজ কিছু করে দিত। পাখা পরিস্কার করবে? দাঁড়া, জগা আসুক।
কুলুঙ্গি<span class="text_exposed_show"> থেকে জিনিস পাড়তে হবে? দাঁড়া
জগাকে খবর দিই। এরকম সব ব্যাপার। ধুতি কোঁচান তো দেখেছি জগাদাদা ছাড়া হতই
না। আর জগাকে দেখলে আমার বাবার গা-টেপানো পেয়ে যেত। সারাদিন থাকত জগাদাদা।
কাজকর্ম করে দিত, খাওয়া-দাওয়া করত। গল্পগুজব করত, মূলতঃ ওম্মার সঙ্গে।
তারপরে সন্ধ্যে-রাত্তিরের দিকে চলে যেত। বাড়িতে কারুর বিয়ে-টিয়ে হলে দুদিন
আগে জগাদাদা চলে আসত আর একা হাতে বহুদিক সামলাত। যগ্যিবাড়ির বাজার হবে কলেজ
স্ট্রীট থেকে - জগাদাদা। গায়ে হলুদের মাছ আনতে হবে - জগাদাদা। বিয়ের ফুল -
জগাদাদা। তার ওপর বিয়েতে নাপিতের কাজও করে দিত জগাদাদা। একদম গ্র্যাটিস।
দাদা আর দিদির বিয়ে অব্দি দেখেছি এই চলেছে। আর ওইসময়ে বার-দুত্তিন এরকম
হয়েছে যে আমরা বাড়ি ফাঁকা করে সদলবলে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি, জগাদাদা এসে
বাড়িতে থেকে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। চুরির একটা ইতিহাস থাকায় মা-র মনে
খুঁতখুঁতুনি দেখেছি, কিন্তু আবার ভরসা করে ছেড়ে যেতেও দেখেছি। </span><br />
<br />
<div class="text_exposed_show">
জগাদাদার এক না দুই ছেলে ছিল। মাঝেমাঝে এসে বলত ছেলে অমুক ক্লাস। একদিন
বলল ছেলে মাধ্যমিক পাশ করেছে, উচ্চ মাধ্যমিকও পাশ করল। ছেলের চাকরি পাওয়ার
কথাও যেন শুনেছিলাম। আমি ৯৩ সালে দেশ ছাড়ি। নব্বইয়ের দশক থেকেই জগাগদাদার
আসা কমে যেতে থাকে। বয়েসও হচ্ছিল। ১৯৯৭-তে ওম্মা মারা যাবার পরে সে আসা আরও
কমে যায়। শুনেছিলাম রিটায়ার করে জগাদাদা ঊড়িষ্যায় নিজের ভিটেতে ফিরে গেছে।<br />
<br />
এখন তো কেউ চাকর-ঝি রাখে না। বাড়িতে কাজের লোক বা কাজের মাসী কাজ করে।
কিন্তু তাদের সঙ্গে এই দীর্ঘ ওঠা-পড়ার সম্পর্ক কি তৈরি হয়? কে জানে!</div>
</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-62965760459885932632016-06-02T10:55:00.000-07:002016-06-02T10:55:33.790-07:00পুরানা সল্ট লেক<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
সল্ট লেক তখনও ফাঁকা ছিল। বাড়ির থেকে ফাঁকা প্লটের সংখ্যাই বেশি। সেক্টর
ওয়ানেই। যারা সল্ট লেক ভাল চেনেন তারা বুঝবেন কতটা ফাঁকা যদি বলি যে তিন
নম্বর ট্যাঙ্ক থেকে বিডি মার্কেট যাবার রাস্তায় ডানদিক (সিডি ব্লকের দিকটা)
পুরোটা খালি ছিল। কিম্বা তিন নম্বরের আইল্যান্ড থেকে বিডির ব্যাঙ্ক অফ
বরোদা বাস-স্ট্যান্ড অব্দি গোটা চার-পাঁচ বাড়ি ছাড়া বাকিটা খোলা মাঠ। আর সে
মাঠে তখনও মাটি জমাট বাঁধেনি। ঘাসের তলায় সাদা বালি পাওয়া যেত। <br />
বিডি স্কুল তখন একটি মাত্র দোতলা বাড়ি। মাঝে শান-বাঁধান উঠোন তখনও <span class="text_exposed_show">শান-হীন, কোণের জলখাবার জায়গাও হয়নি। </span><br />
<br />
<div class="text_exposed_show">
এখন যেখানে সিটি সেন্টার - ডিসি ব্লক - সেখানে একটাও - ইয়েস একটাও - বাড়ি
ছিলনা। ছিল শুধু সুচারু স্তুপ করে রাখা স্টোনচিপ। তার উল্টোদিকে, যেখানে
মনজিনি'স-এর দোকান-টোকান আছে - ডিডি ব্লক, সেও অধিকাংশই খালি, শুধু হসপিটাল
আর সেবা। আর মোড়ের মাথায় তৈরি হতে শুরু করল "শিবম" নামের সিনেমা হল। সল্ট
লেকের প্রথম হল। কিন্তু সে আর শেষ হল না। ইতিহাস নিয়ে ধংসস্তুপ হয়ে তার
কংকাল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আর ফাঁকা ছিল বিদ্যাসাগর হাউসিং-এর সামনের মাঠ।
পুরো ফাঁকা। বিদ্যাসাগরের গেট থেকে সেন্ট্রাল স্কুল দেখা যেত পরিস্কার।<br />
একেবারে আক্ষরিকভাবেই চোখের সামনে তৈরি হল ডি সি পালের বাড়ি, ইসি স্কুল -
এডি স্কুলের মেয়েরা সেখানে স্থানান্তরিত হয়ে গেল, সল্ট লেক স্টেডিয়াম -
প্রথম খেলা ১৯৮৪ সালের নেহেরু কাপের ফাইনাল, প্রথম পেট্রল পাম্প -
স্টেডিয়ামের উল্টোদিকে, বিদ্যুৎ ভবন। করুণাময়ী ভরে উঠল। ওদিকে পূর্বাচল,
কালোবাড়ি, মহাবীর বিকাশ। সিটি সেন্টার-টেন্টার তো এই সেদিনের ছোকরা - হয়েছে
আমি দেশ ছাড়ারও পরে।<br />
বড় পুজো বলতে লাবণী, বিডি ব্লক আর এই ব্লক।
যদিও প্রায় প্রতি ব্লকেই পুজো হত। এফডি ব্লক নাম করল নব্বইয়ের দশকে এসে।
প্রথম রেস্টোর্যান্ট বিই ব্লকের ড্যান-ডিন। প্রথম নামী স্টুডিও - স্টুডিও
মনোরমা।
সিএ মার্কেট বা বিডি মার্কেটে কোন স্টুডিও ছিল বলে মনে পড়ছে না। তবে বিডি
মার্কেটের দোতলায় একটা লাইব্রেরি ছিল। কিরীটি থেকে শুরু করে আশুতোষ
মুখোপাধ্যায়ের "বলাকার মন" - কিচ্ছু বাদ দিইনি।<br />
<br />
আমরা যখন সল্ট লেকে
গেছি তখন বাস বলতে ৪৬এ, ৪৪এ, ৯, এস-১৪, এস-১৬, এল-১৪এ, এল-১৪বি, সল্ট
লেক-যাদবপুর মিনি। আর কোন মিনি চলত বল মনে পড়ছে না। অটো তখনও আসেনি
কলকাতায়। খুব চলত সাইকেল রিক্স। আর ছিল সাইকেল - ছেলে থেকে বুড়ো।<br />
<br />
<div style="text-align: center;">
<a href="http://2.bp.blogspot.com/-jGruLMju1Yw/V1By224YneI/AAAAAAAACuo/FDPecj9yyFEjdYd3Z--BqGwknHf1t--twCK4B/s1600/tank.jpg" imageanchor="1"><img border="0" height="180" src="https://2.bp.blogspot.com/-jGruLMju1Yw/V1By224YneI/AAAAAAAACuo/FDPecj9yyFEjdYd3Z--BqGwknHf1t--twCK4B/s320/tank.jpg" width="320" /></a> </div>
<br />
আর ছিল ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কই সল্ট লেকের প্রাণভ্রমরা, সল্ট লেকের নিশানা।</div>
</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-30305314370597434862016-06-02T10:51:00.000-07:002016-06-02T10:55:58.906-07:00খাবার-দাবার<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
আজ একটা দোকানে খাবার কিনতে গেছিলাম। ছেলেটি আমার পদবী শুনে জিগেস করল
আমি কোথাকার বাঙালি? বললাম, কলকাতার। জানলাম, সেও কলকাতার। বাড়ি জাকারিয়া
স্ট্রীটে। বড়বাজারেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। হোটেল ম্যানেজমেন্ট করে অ্যামেরিকায়
এসে রেস্টোরেন্টে কাজ করছে। আদতে উত্তর প্রদেশের লোক। নাম শাইর কুরেশি।
বাপ-দাদা-কাকাদের মাংসর দোকান সারা কলকাতায় ছড়িয়ে।<br />
<br />
<a href="http://3.bp.blogspot.com/-BE59IbMZVBs/V1BxdVQ7T1I/AAAAAAAACuU/f4L7F4DtUbcro1L8zy5XYpnETL4Y3EuvgCK4B/s1600/zakaria.png" imageanchor="1"><img border="0" height="272" src="https://3.bp.blogspot.com/-BE59IbMZVBs/V1BxdVQ7T1I/AAAAAAAACuU/f4L7F4DtUbcro1L8zy5XYpnETL4Y3EuvgCK4B/s640/zakaria.png" width="640" /></a><br />
<br />
<br />
জাকারিয়া
স্ট্রীট বলতেই মনে পড়ে গেল "দেশে-বিদেশে"-তে মুজতবা আলী জাকারিয়া স্ট্রীটে
কাবাব কেনার কথা লিখেছেন। (আহা, মুজতবা!!) তো তাকে জিগেস করলাম সে সব দো<span class="text_exposed_show">কান
এখনও আছে কিনা। বলল, আলবাত আছে। তারপরে, যথারীতি আলাপ চলল খাবার নিয়ে। তার
কাছে জানলাম কলকাতার সেরা নেহারি নাকি নাখোদা মসজিদের উল্টোদিকে সুফিয়া
রেস্তোঁরায়। বলল, এই রমজান আসছে। এ মরশুমে সুফিয়ার নেহারি না খেলে জীবন
বৃথা। তবে যেতে হবে খুব ভোর-ভোর। সাতটার পরে যে নেহারি মিলবে সে একেবারেই
এলেবেলে। "আর বিরিয়ানি?" সুফিয়ার পাশেই নাকি আছে আরেক আমিনিয়া।
এস্প্ল্যানেডের আমিনিয়ারই ভাই, কিন্তু ফ্র্যানচাইজি নয়, ব্রাঞ্চ নয়। দুটোই
আদত। এই জাকারিয়া স্ট্রীটের আমিনিয়ায় নাকি খেতে হয় বিফ বিরিয়ানি আর হালিম। </span><br />
<br />
দেশে কবে যাব তো জানিনা। কেউ ও তল্লাটে গিয়ে চেখে এলে এট্টু খবর দেবেন। নইলে খুব চিন্তায় থাকব।</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-16028399416358941472015-04-16T17:16:00.000-07:002015-04-16T17:16:52.089-07:00জলধরবাবুর দেশে ফেরা<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
জলধরবাবু একজন পোড়-খাওয়া এন আর আই বা ভাপাভা ("ভারত-পালানো-ভারতীয়") । তাঁর
লেট-যৌবন-আর্লি-প্রৌঢ়ত্বে জলধরবাবু <a href="http://atikathan.blogspot.com/2010/07/blog-post.html" target="_blank">একটি মস্করামূলক প্রবন্ধ</a> লিখে
হালকা করে দেশে ফেরত যাবার মনোবাসনা ব্যক্ত করেছিলেন । দোষের মধ্যে তো এই ।
এই দেখেই আকাশের দেবতা মুচকি হাসিলেন । বলিলেন, "তোর ফেসবুক পোস্টিং ১০০১
বার শেয়ার না করাতেই বর দিলাম । যাবি তো যা ।" অতঃপর জলধরবাবু
বৌ-বাচ্চা-বাক্স-প্যাঁটরাসহ ভারতবর্ষে ল্যান্ড করলেন ও ধান-চালের পারস্পরিক
সম্পর্ক সম্বন্ধে অবহিত হলেন । সংবর্ধনার একটা ক্ষীণ আশা পালন করলেও মনে
মনে বুঝে গেছিলেন নাগরিক সংবর্ধনা হবে না । তবে কাছে দূরের আত্মীয়-বন্ধু কি
আর চোখ গোলগোল ও ছলছল করে তাঁর দেশে ফেরার একটা মূল্য দেবে না !<br />
<br />
সে গুড়ে বালি । ফিরে দেখলেন বাপে-খেদানো-মায়ে-তাড়ানো ভাপাভার দল পঙ্গপালের
মতন দেশে ফিরছে । সব বড় এয়ারপোর্ট হাওড়া স্টেশন । বিলেতফেরত উদ্বাস্তুতে
ভরে গেছে । সকলের চোখেই অন্য উদ্বাস্তুর পরিবারের প্রতি তাচ্ছিল্য ও উষ্মা,
"আরেক পিস কম্পিটিশন!" দেশোয়ালি বেরাদরদের চোখে ব্যঙ্গ, "সেই তো আবার ফিরে
এলি ! সাহেবরা রাখল না?" জলধরবাবু ব্যাঙ্গালোরে এক পিস চাকরি জোটালেন ।<br />
<br />
ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে জলধরবাবুর জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হল। উপলব্ধি করলেন যে
ভারতবর্ষকে ত্যজ্য করেছিলেন আর যে ভারতবর্ষকে ফের বরণ করলেন, তারা দুটি
আলাদা প্রাণী, আদতে এক হলেও। তার একটি কারণ যদি হয় মাঝে ষোল-সতেরো বছর
বিভিন্ন ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে যেতে যেতে নিয়ে এসেছে উদারীকরণের মনমোহনীয়া
চকসা, আর একটি কারণ হবে কলকাতা ও ব্যাঙ্গালোরের তফাত। আজকের ব্যাঙ্গালোর
যদি একবিংশ শতকের ভারতবর্ষ হয় তো ষোল বছর আগে কলকাতা তবে ঊনবিংশ শতকের
বর্মা।<br />
<br />
সদ্য-প্রস্ফুটিত জ্ঞানচক্ষু মেলে জলধরবাবু যা দেখলেন তা হল নিম্নরূপ -<br />
<br />
১। মধ্যবিত্তের সংসার চালানর জন্যে না-হলেই-নয় এমন জিনিসের দাম বেড়েছে ছ-সাত গুণ।<br />
২। না-হলেও-চলে-তবে-হলে-ভাল জিনিসের দাম বেড়েছে দশ-বারো গুণ।<br />
৩। আগে পাওয়া যেত না এমন বিলাস বস্তুতে বাজার ছেয়ে গিয়েছে, এবং সেসব জিনিসের হাতপোড়ানো দাম।<br />
৪। লোকের, জলধরবাবুর পরিচিত মানুষজনের, মাসমাইনে হরবখত লাখ-বেলাখ। প্রায়
সবাইকার গাড়ি আছে। পঁয়তিরিশের মধ্যে চাকুরেরা ফ্ল্যাট কিনে ফেলছেন।<br />
<br />
জলধরবাবু বাকরুদ্ধ হলেন।<br />
<br />
ক্রমে ধাতস্থ হয়ে উপলব্ধি করলেন ভারতবর্ষ আসলে এক নয়, বহু। নিজের বাড়িতেই
দুই ভারতবর্ষের রূপ চাক্ষুস করতে লাগলেন অহরহ। পরিবারের ছজন মিলে মোটামুটি
ভদ্রস্থ রেস্তোঁরায় সপ্তাহান্তিক পানভোজনের বিল দিয়ে গাড়িতে উঠে খেয়াল পড়ে
সেই বিলের পরিমাণ বাইরে এতক্ষণ অপেক্ষমান চালকের মাসমাইনের অর্ধেক। খেয়াল
পড়ে প্রথম-প্রথম বার কয়েক বাড়ির পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোঁরায় বসে
খেলেও সে ঘটনা কমতে-কমতে শূন্যে এসে ঠেকেছে। সবথেকে যা ভয়াবহ, বুঝতে পারেন
শিশুকন্যাদ্বয় মার্ক্সসাহেবের তত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত না হয়েও শ্রেণী ও
শ্রেণীচরিত্র সম্বন্ধে প্র্যাক্টিকাল পাঠ হরবখত নিচ্ছে দৈনন্দিন
প্রাত্যহিকতা থেকে - একদল হুকুম করে, সে যতই মধুগুড় মাখান হুকুম হোক না কেন
এবং আর একদল সে হুকুম তামিল করে। জলধরবাবু সকাল-সন্ধ্যে "দীনবন্ধু, পার
করো" বলে কেঁদে ককিয়েও হালে পানি পান না।<br />
<br />
শিশুকালে স্কুলের প্রেয়ারে চেঁচিয়ে গেয়েছেন "বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান"।
কিন্তু সে মহান যে কী ভাবে দেখা যায় কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু জলধরবাবু এবার
দেখলেন। বেশ ভাল করেই দেখলেন। সাড়ে বত্তিরিশভাজা বিবিধ ভারতের মাঝে বলিউডি
মিলনের মাহাত্ম্য। রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে - সর্বত্র বলিউড। টিভিতে বলিউড।
রেডিওয় বলিউড। জামায় বলিউড। কাপড়ে বলিউড। সর্বভারতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায়
বলিউড। শিশুদের বিনোদনে বলিউড। জলধরবাবু খাবি খেলেন। খেয়ে মন দিয়ে মেয়েদের
সঙ্গে ছোটা ভীম দেখতে লাগলেন। তবে প্রযুক্তির কী মাহাত্ম্য! শুধু বলিউডই
নয়। খোদ কন্নড়ল্যান্ডে বসে প্রতি সন্ধ্যেয় গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন বাংলা
চ্যানেলের সিরিয়াল। যে সিরিয়ালে সবাই বাড়িতে পূর্ণ সেজে থাকে। সব পরিবারই
যৌথ। সব পরিবারেই কুচুটে লোকেরা অন্যকে প্রাণে মেরে দেবার চক্রান্ত চালিয়ে
যায় প্রতি সন্ধ্যেয়। সবারই ঘোরতর গুন্ডাদলের সঙ্গে খুব দহরম-মহরম চলে। বিষ
অতি সহজলভ্য।<br />
<br />
জলধরবাবু ঘামতে লাগলেন।<br />
<br />
ঘামার সুযোগ জলধরবাবু বিশেষ পান না। একে ব্যঙ্গালোরের অতি মনোরম চির-বসন্ত
টাইপ আবহাওয়ায় ঘামার সুযোগ প্রায় পাওয়াই যায় না, তার ওপর জলধরবাবু যে
বুদবুদে বাসা নিয়েছেন সেখানে লোডশেডিং হলেই পাওয়ার ব্যাকাপ চালু হয়ে যায়
অতি দ্রুত। সে ব্যাকাপে রেফ্রিজারেটর চলে, মাইক্রোয়েভ চলে, টিভি চলে,
আলো-পাখা চলে, এসি চলে, গিজারও চলে বোধহয়। না চললে চলবেই বা কেন। লোডশেডিং
হয় বটে! মুহুর্মুহু। এই আছে , এই নেই। জলধরবাবুর সত্তর-আশির দশকের কলকাতায়
লোডশেডিং-এর সুবর্ণ যুগের কথা মনে পড়ে যায়। হায় সেই সব দিন। বুকের গভীর
থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জলধরবাবুর। কোথায় গেল সেই ঘরে ঘরে
লম্প-কুপি-হ্যারিকেনের দিনগুলি! রোজ সকালে লম্প-হ্যারিকেনের কাঁচ পরিস্কার
করার রুটিন ছিল। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো এসব কিছু শিখলই না!!<br />
<br />
কিন্তু জলধরবাবু শিখছেন। প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু শিখছেন। সব শেখাই যে নতুন
তা নয়। অনেক কিছুই ফিরিঙ্গি-কুসঙ্গে ভুলে গেছিলেন, এখন আবার ঝালাই হয়ে
যাচ্ছে। যেমন কেউই সময়ে আসে না। ফোন করলেই বলে "ইন ফাইভ মিনিট্স"। সবাই
মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আপিসের লোকেদের পরস্পরকে ফোন করা যায় যখন-তখন।
দোকানপাট-আপিস বিল্ডিং-রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স-সিনেমা
হল-হোটেল-রেস্টোর্যান্ট-শপিং মল - সর্বত্র গেটে সিকিউরিটি গার্ড। পোশাকের
কায়দা দেখে খানাতল্লাশি কতটা হবে তা স্থির হয়। গাড়ি নিয়ে ঢুকতে গেলে গাড়ির
ট্রাংক খুলে দেখান। কিন্তু ট্রাংকে সুটকেস-টুসকেস থাকলে সে সব খুলতে হয় না।
কাজেই যদি কোন কারণে আপনি সিকিউরিটির হাতে ধরা পড়তে চান, বোমা-টোমা
সুটকেসে রাখবেন না। পুরোন দিনের হিন্দি ছবিতে যেরকম দেখাত, সেই মতন বোমার
ওপরে ওপরে বড় বড় করে "বোমা" লিখে ট্রাংকে রেখে দেবেন।<br />
<br />
এবং মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অ্যামেরিকা-ফেরত জলধরবাবু এক
অনাস্বাদিত মুক্তির হাওয়া পেলেন। নিজের পয়সা দিয়ে কেনা জিনিস যে নিজস্ব হতে
পারে, অ্যামেরিকায় বসবাস করে এ ব্যাপার প্রায় ভুলতে বসেছিলেন।
নিজের-পয়সা-দিয়ে-কেনা কম্পিউটারে নিজের পছন্দের অপারেটিং সিস্টেম লাগাবেন?
হবে, যদি কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার অনুমতি দেয়। যে অপারেটিং সিস্টেম পয়সা
দিয়ে কিনেছেন, সেটিও আপনার নয়। কারণ আপনি তো কেনেননি, লাইসেন্স নিয়েছেন।
সার্ভিস প্রোভাইডার নামমাত্র দামে, সময়বিশেষে এমনকি বিনি পয়সায়, মোবাইল ফোন
দেয়। বদলে বন্ধক রাখতে হয় নিজের জিনিস নিজের করার স্বাধীনতাটি। তবে
স্মার্ট ফোনের রমরমা আসার পর শুনেছেন অব্স্থার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। অথচ
ভারতে? গটগট করে দোকানে ঢুকলেন জলধরবাবু, পয়সা দিলেন, নতুন ফোনে পেলেন।
সার্ভিস প্রোভাইডারের আপিস থেকে আগেই সিম কার্ডটি হস্তগত করে চালু করে
রেখেছিলেন। সে সিম কার্ডটি এবার স্বস্থানে বসালেন। ব্যস। এবার নিজ মাল নিজ
দায়িত্বে।<br />
<br />
সিম ভরার ঠিক সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে প্রথম কলটি এল। নিজের ফোনে প্রথম
নিজের কল। আহ্লাদে জলধরবাবু আটখানা। "হ্যালো"। "হ্যালো স্যার, দিস ইজ
সুনিধি ফ্রম অমুক ব্যংক। উই আর গিভিং পার্সোনাল লোন আপটু ফিফটি থাউজ্যান্ড
..."। জলধরবাবু বুঝলেন বিনামূল্যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। তার মূল্য
হাতে-হাতে চুকিয়ে দিতে হয়।<br />
<br />
যত সহজে সার্ভিস প্রোভাইডারের আপিস থেকে সিম কার্ড পাওয়ার কথা লেখা হল,
ইতিহাস বলে, কাঠখড় তার কিছু বেশিই পোড়াতে হয়েছিল। তার কারণ একটিই।
অ্যাড্রেস প্রুফ। এ গ্যাঁড়াকলে যে না ফেঁসেছে তার পক্ষে গর্দিশের অবস্থা
কল্পনা করা দুষ্কর। মোবাইল ফোনের অ্যাকাউন্ট করবেন? অ্যাড্রেস প্রুফ নিয়ে
আসুন। ল্যান্ডলাইনের সরকারি ফোন বিল, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স - সব
চলেগা। চলেগা তো, কিন্তু মিলেগা কোথায়? বাড়িই এখনও ভাড়া করেননি তো
ল্যান্ডলাইন! আর করলেও কোন দুঃখে সরকারি বিএসএনএল নেবেন? বেঁচে থাক
প্রাইভেট সেক্টর। আর পাসপোর্ট? সে তো বদল হয়ে গেছে। মার্কিন-নাগরিক
জলধরবাবু তো আক্ষরিক অর্থে নিজদেশে পরবাসী। বাকি রইল ড্রাইভিং লাইসেন্স।
কিন্তু সে করতে গেলেও তো অ্যাড্রেস প্রুফ লাগবে। কিরকম অ্যাড্রেস প্রুফ
চলবে? কেন বাড়ি ভাড়ার দলিল। ব্যস, সার্কল কমপ্লিট। যেখান থেকে শুরু
করেছিলেন, ফিনসে সেখানে। ক-য়ে কমললোচন ইত্যাদি। যাকগে, এ ব্যাপারে ফেনিয়ে
লাভ নেই। তবে অ্যাড্রেস প্রুফ ভারতে এক মহার্ঘ্য জিনিস। কিন্তু দাঁতের মতন।
যার আছে সে এর মর্যাদা বোঝে না। এর সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজ ছবিটিও ভুলবেন না।
ওটিরও চাহিদা প্রবল। সবাই ২০১১ সালে জলধরবাবু কেমন দেখতে ছিলেন তা
ডকুমেন্ট করে রাখতে চায়। কানাঘুষোয় এ-ও শুনেছেন যে সুলভ শৌচালয়ে "পয়সার
বিনিময় শৌচকর্ম" করতে গেলেও নাকি প্রতিবার একটি করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি জমা
করতে হবে।<br />
<br />
অতএব জলধরবাবু এখন সর্বদা পকেটে দুটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে ঘোরেন।<br />
<br />
জলধরবাবু স্বপ্ন দেখতেন দেশে ফিরে সকালে থলি দুলিয়ে বাজারে যাবেন। দরদাম
করে কিনে ফেলবেন টাটকা কাঁচকলা, সবুজ ঝিঙে, কচি পটল, নিদাগ বেগুণ, ঘাই-মারা
কই কী রক্তঝরা কাটাপোনা। তবে এ ভারত বাবা-কাকাদের আমলের ভারত নয়, এ হল
গিয়ে চকচকে ভারতবর্ষ। আর ব্যাঙ্গালোরও কলকাতা নয়। কাজেই থলি দুলিয়ে বাজার
যাওয়ার সময় পেলেন শুধু শনি-রবিবার। কিন্তু বাজার মানে বাজারই। ফিরিঙ্গি
হনুকরণের তারের গাড়িঠেলা সুপারমার্কেট নয়। এ হল ব্যাঙ্গালোরের ঐতিহ্যবাহী
হ্যাল মার্কেট। আগে নাকি বাঙালীর ছোটখাটো মিলনক্ষেত্র ছিল। এখনও আছে। এখানে
আসে অন্ধ্রের রুই, চট্টগ্রামের ইলিশ, কলকাতার কচুর-লতি থেকে চিংড়ি, ঝর্ণা
ঘি থেকে সানন্দা। রুই একশো ষাট, যদিও টোটাল ধরণের সুপারমার্কেটে একশো কুড়ি।
কারণ টোটালের মাছ লোকাল। ইলিশ সাতশো-আটশো গ্রামের বেশি ওজনের পাওয়াই যায়
না। পেলে হাজারের ওপর দাম। নইলে সাতশো-আটশো-নশো। ভেটকি সাড়ে তিনশো। বড়
চিংড়ি সাড়ে চারশো। তুলনামূলকভাবে চিংড়ির দামই গেল তিরিশ-চল্লিশ বছরে কম
বেড়েছে। প্রতিবার মাছ কিনে ফেরার সময়ে জলধরবাবু প্রতিজ্ঞা করেন পরিবারসুদ্ধ
ভাত আর বাটারমিল্ক ডায়েটে পরিবর্তিত হয়ে যাবেন। পরিবর্তনেরই তো বাজার। তার
ওপর ভাত-বাটারমিল্ক খেয়ে ভারতের আই-এ-এস ক্যাডার যদি ভর্তি করে ফেলা যায়
তো বাঙালির এত কি আম্বা যে মাছ না খেলে চলবে না!<br />
<br />
বলতে নেই, জলধরবাবু নোলাটি বেশ স্বাস্থ্যবান। আজ আরশোলার চচ্চড়ি খেয়ে
ফেললেন তো কাল জেলিফিশের মালাইকারি - এরকম দুঃসাহসী না হলেও, চেনাশোনা
খাবারের বড়সড় গন্ডির মধ্যে ঘোরাফেরা করে থাকেন। কলকাতা জলধরবাবুর স্বর্গ।
পাড়ার মোড়ের "কমলে কামিনী কাফে"র হাড়-সর্বস্ব কষা মাংসর যা সোয়াদ,
অ্যামেরিকার বাঘা-বাঘা নামের, জ্যাগাত কি মিশেলিন রেটেড দোকানও তার
ধারেকাছে আসতে পারে না। ব্যাঙ্গালোরে মোড়ের দোকানে বাঙালি কষা মাংস না
পাওয়া গেলেও, আপিসের মোড়ের অখ্যাত দোকানে যে তন্দুরি চিকেন বানাত, সে খেতে
দীর্ঘ পথ হাঁটতেও রাজি ছিলেন জলধরবাবু। তাছাড়া দেশে ফেরার মাস খানেকের
মধ্যে আবিষ্কার করে ফেললেন কোরামঙ্গলার আওধি খাবারের দোকান তুন্ডে কাবাবিতে
রুমালি রুটি আর তুন্ডে কাবাব। একদম লা-জবাব। খুঁজে পেলেন কলকাত্তাইয়া
লাজিজ ও আর্সালান - হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির থেকে মুখ বদল করতে কলকাতা-স্টাইল
বিরিয়ানি আর চিকেন টিক্কা গ্রেভি। হায়্দ্রাবাদী বিরিয়ানি খেতে চার্চ
স্ট্রীটের "সমরখন্দ", যা নামেই আফগান। আসলে উত্তরভারতীয় কাবাব, নল্লি আর
বিরিয়ানির ফার্স্ট ক্লাস ঠেক। হানা দিলেন ভারতে চলা প্রথম ট্রেনের থিমে
তৈরি রেস্তোঁরা "সাহিব-সিন্ধ-সুলতান"। এদের বিরিয়ানির খুব নাম থাকলেও
পুদিনাগন্ধী হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি জলধরবাবুর খুব পোষাল না, কিন্তু বাকি
খাবারদাবার দিব্যি ভাল। শিখে গেলেন মালায়লি দোকানে মাটন স্টু দিয়ে আপ্পম
খাবার রীতিনীতি। কাজেই আপাতত শান্তিকল্যাণ।<br />
<br />
অথচ বড় মুখ করে স্টেক খেতে গিয়ে খুব হেনস্থা হলেন যা হোক। ফাইবার সর্বস্ব
স্বাদহীন মাংসখন্ড। মিডিয়াম-রেয়ার চাইলেন, করে আনল চারকোল। ওয়েলডান চাইলে
মাংসর মধ্যবর্তীস্থান লাল ও ঠান্ডা। সর্বোপরি সব স্টেকের ওপরেই গ্রেভি
ঢালা। মেয়েদের স্প্যাগেটি-অ্যান্ড-মিটবল খাওয়াতে ব্যাঙ্গালোরের নামী
ইটালিয়ান রেস্তোঁরায় ঢুকে আবিষ্কার করলেন সেটি ভেজিটেরিয়ান ইটালিয়ান।
ন্যাকামো! জলকে যাব, বেণী ভিজাব না! মদও পাওয়া যায়না, তার বদলে মেলে
রঙবেরঙের শোভনদর্শন মকটেল। দক্ষিণ-ভারতীয় উচ্চকোটির ব্রাহ্মণেরও কৌলিন্য
যাবার কোন ভয় নেই। আবিষ্কার করে রোমাঞ্চিত হলেন ঠিকই, খাবারও খারাপ নয়,
কিন্তু খুব যে উৎসাহিত বোধ করলেন, এমন নয়। আর ততক্ষণে দেরি যা হবার হয়ে
গেছে। এবং কেরমে কেরমে আবিষ্কার করলেন দেশের বিজাতীয় খানাবিপণিগুলো কোন
কঠোর কঠিন কুইজিনত্ব রক্ষা করার ঠিকা ও দায় নেয় নি। কাজেই ইটালিয়ান
রেস্তোঁরায় পেতেই পারেন ফাহিতা, চিনে দোকানে পাবেনই পাবেন কোরিয়ান কিমচি ও
থাই টম ইয়ুম সুপ। জলধরবাবুও আজকাল নির্বিকারমুখে ইডলির সঙ্গে আলুদ্দম খেতে
পারেন, রসম দিয়ে ফ্রায়েড রাইস।<br />
<br />
কাজেই ব্যাঙ্গালোর দিব্যি জায়গা। শুধু সারাদিন মনে হয় একটি রাক্ষুসে
কনস্ট্রাকশান সাইটে বসে আছেন। বাতাসে সুরকির গন্ধ। বুটজুতোয় সিমেন্টের
ধুলো। বুদবুদ থেকে বেরোলেই চতুর্দিকে ঠং-ঠং ঘটঘট ধুপধাপ শব্দে বাড়ি হচ্ছে,
আপিস হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে, নতুন ব্রিজ বানানো চলছে। কিছুদিন এসব লক্ষ্য
করে জলধরবাবু খেয়াল করলেন যে এত সব যে এরা বানাচ্ছে, কেউ কিন্তু কোন নতুন
রাস্তা বানাবার দিকে নজর দিচ্ছে না। ফ্লাইওভারও যে হচ্ছে তাতে আন্ডারের
রাস্তা আর কার্যকরী রাস্তা থাকছে না। যদিও বা থাকে তবে অপেক্ষায় থাকছে
দুদিন বাদে মেট্রোর জন্যে লম্বা আখাম্বা থাম্বা এসে কবে তাকে আপন করে নেবে -
এই ভেবে। জলধরবাবু দাড়িটাড়ি চুলকে ভাবতে থাকেন, তবে ফ্লাইওভার বানিয়ে
রাস্তা উঁচু করা ছাড়া ঘোড়াড্ডিমের হলটা কী? এছাড়া এর বাড়ির দাওয়া, তার
বাড়ির উঠোনের ভেতর দিয়ে ভাঙাচোরা, প্রায়-নেই, চার-হাত চওড়া রাস্তা দিয়ে
যেতে যেতে দেখেন দুধারে প্রাক্তন চাষের জমিরা গ্রাম্য রূপ ছেড়ে সাহেবী
পোষাক পরছে - উঠছে হর্ম্যের পর হর্ম্য - যা কোটি কোটি টাকায় বিকোবে।
জলধরবাবু ভাবেন, এ সবই তো উন্নতি লক্ষণ। কিন্তু বাবাসকল, এই যে অট্টালিকা
বানাচ্ছ, এখানে এসে হাজারের কাছাকাছি লোক থাকবে একদিন - সেই অট্টালিকায়
পৌঁছতে তো হাতে হ্যারিকেন, প্যান্টুল ঢলঢলে ও গালে দাড়ি গজিয়ে যাবে! কিন্তু
কে শোনে কার কথা! মাঝে মাঝে মনে হয় চিৎকার করে বলেন, "বাপু হে, রাস্তাটা
ভুলো না।" কিছু কিছু কমপ্লেক্স তো শহর থেকে দূরত্বের কারণহেতু এবং
রাস্তাহীনতার কারণে প্ল্যানে হেলিপ্যাডের বন্দোবস্ত রেখেছে। এ কথা জলধরবাবু
নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে বেগ পেলেন।<br />
<br />
ব্যাঙ্গালোর আজব শহর। প্রাচ্যের সিলিকন ভ্যালি। নামকরা হুদো হুদো কোম্পানি
যেচে গিয়ে আপিস ফাঁদছে আর ট্যাক্সো দিচ্ছে। রাস্তায় আধুনিক কেতার লাখে
লাখে গাড়ি। অ্যামবাসেডরের মতন কুলীন গাড়ি রাস্তায় দেখাই যায় না।
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জিনিসের বিজ্ঞাপনে রাস্তা-বাড়ি-মানুষ সবেরই মুখ
ঢেকে যায়। রাস্তায় চলছে পেল্লায় ও আধুনিক বাস। সারি সারি দামী জিনিসের
চকচকে দোকানের মাঝে দুখীমুখে উঁকি মারে পাড়ার মনোহারী দোকান, মুদির দোকান,
চুল কাটার সেলুন, ছিটকাপড়ের দোকান। অথচ রাস্তার ধারে ওপেন ড্রেন। শহরজুড়েই।
এই একবিংশ শতাব্দীর শাইনিং ইন্ডিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হাইটেক
শহরে। এবং নোংরাস্য নোংরা নিষ্কাশনী খাল। আর বিষজল-ভরা লেক। সে লেকও
দেখ-তো-দেখ ময়লা-টয়লা ঢেলে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তারপরেই নীল করোগেটেড শিট
দিয়ে বাউন্ডারি ও বিল্ডারের সাইনবোর্ড - লেকভিউ অ্যাপার্টমেন্ট। ভিউ লেকে
আছে ঠিকই - যদিও কদ্দিন থাকবে বলা যাচ্ছে না কারণ অন্য বিল্ডাররাও তো সেই
একই লেক বুজিয়েই লেকভিস্তা, ওয়াটারফ্রন্ট, অ্যাকোয়াভিউ প্রভৃতি হর্ম্যসমূহ
বানাইতেছে। আরও যেটা বলা নেই সে হল বিষ জলের দুর্গন্ধ ও ঝাঁকে ঝাঁকে
মশককুলের আগমন ও বসতিস্থাপন। জলধরবাবু বোঝেন খুব শিগ্গিরই ব্যাঙ্গালোরে আর
কোন ওয়াটার বডি থাকবে না। দূরদূরান্ত থেকে ট্যাংকারে জল আসবে। রাস্তাও উবে
যাবে। থাকবে শুধু থিকথিকে, দলা দলা বহুতল হর্ম্য, অট্টালিকা ও সারণী।
রাস্তায় মেঘ নয়, গাভীর মতন চরবে হেলিকপ্টার।<br />
<br />
শেষের ভয়ংকর সেদিনের কথা ভেবে জলধরবাবু শিউরে উঠলেন।<br />
<br />
[প্রথম প্রকাশ, ২৫-শে অক্টোবর, ২০১৩ <a href="http://www.guruchandali.com/blog/2013/10/25/1382657543822.html#.VTBPqpNtH08" target="_blank">গুরুচন্ডালী ডট কম</a>]<br />
undefined<br />
<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
জলধরবাবু একজন পোড়-খাওয়া এন আর আই বা ভাপাভা ("ভারত-পালানো-ভারতীয়") । তাঁর
লেট-যৌবন-আর্লি-প্রৌঢ়ত্বে জলধরবাবু <a href="http://atikathan.blogspot.com/2010/07/blog-post.html" target="_blank">একটি মস্করামূলক প্রবন্ধ</a> লিখে
হালকা করে দেশে ফেরত যাবার মনোবাসনা ব্যক্ত করেছিলেন । দোষের মধ্যে তো এই ।
এই দেখেই আকাশের দেবতা মুচকি হাসিলেন । বলিলেন, "তোর ফেসবুক পোস্টিং ১০০১
বার শেয়ার না করাতেই বর দিলাম । যাবি তো যা ।" অতঃপর জলধরবাবু
বৌ-বাচ্চা-বাক্স-প্যাঁটরাসহ ভারতবর্ষে ল্যান্ড করলেন ও ধান-চালের পারস্পরিক
সম্পর্ক সম্বন্ধে অবহিত হলেন । সংবর্ধনার একটা ক্ষীণ আশা পালন করলেও মনে
মনে বুঝে গেছিলেন নাগরিক সংবর্ধনা হবে না । তবে কাছে দূরের আত্মীয়-বন্ধু কি
আর চোখ গোলগোল ও ছলছল করে তাঁর দেশে ফেরার একটা মূল্য দেবে না !<br />
<br />
সে গুড়ে বালি । ফিরে দেখলেন বাপে-খেদানো-মায়ে-তাড়ানো ভাপাভার দল পঙ্গপালের
মতন দেশে ফিরছে । সব বড় এয়ারপোর্ট হাওড়া স্টেশন । বিলেতফেরত উদ্বাস্তুতে
ভরে গেছে । সকলের চোখেই অন্য উদ্বাস্তুর পরিবারের প্রতি তাচ্ছিল্য ও উষ্মা,
"আরেক পিস কম্পিটিশন!" দেশোয়ালি বেরাদরদের চোখে ব্যঙ্গ, "সেই তো আবার ফিরে
এলি ! সাহেবরা রাখল না?" জলধরবাবু ব্যাঙ্গালোরে এক পিস চাকরি জোটালেন ।<br />
<br />
ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে জলধরবাবুর জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হল। উপলব্ধি করলেন যে
ভারতবর্ষকে ত্যজ্য করেছিলেন আর যে ভারতবর্ষকে ফের বরণ করলেন, তারা দুটি
আলাদা প্রাণী, আদতে এক হলেও। তার একটি কারণ যদি হয় মাঝে ষোল-সতেরো বছর
বিভিন্ন ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে যেতে যেতে নিয়ে এসেছে উদারীকরণের মনমোহনীয়া
চকসা, আর একটি কারণ হবে কলকাতা ও ব্যাঙ্গালোরের তফাত। আজকের ব্যাঙ্গালোর
যদি একবিংশ শতকের ভারতবর্ষ হয় তো ষোল বছর আগে কলকাতা তবে ঊনবিংশ শতকের
বর্মা।<br />
<br />
সদ্য-প্রস্ফুটিত জ্ঞানচক্ষু মেলে জলধরবাবু যা দেখলেন তা হল নিম্নরূপ -<br />
<br />
১। মধ্যবিত্তের সংসার চালানর জন্যে না-হলেই-নয় এমন জিনিসের দাম বেড়েছে ছ-সাত গুণ।<br />
২। না-হলেও-চলে-তবে-হলে-ভাল জিনিসের দাম বেড়েছে দশ-বারো গুণ।<br />
৩। আগে পাওয়া যেত না এমন বিলাস বস্তুতে বাজার ছেয়ে গিয়েছে, এবং সেসব জিনিসের হাতপোড়ানো দাম।<br />
৪। লোকের, জলধরবাবুর পরিচিত মানুষজনের, মাসমাইনে হরবখত লাখ-বেলাখ। প্রায়
সবাইকার গাড়ি আছে। পঁয়তিরিশের মধ্যে চাকুরেরা ফ্ল্যাট কিনে ফেলছেন।<br />
<br />
জলধরবাবু বাকরুদ্ধ হলেন।<br />
<br />
ক্রমে ধাতস্থ হয়ে উপলব্ধি করলেন ভারতবর্ষ আসলে এক নয়, বহু। নিজের বাড়িতেই
দুই ভারতবর্ষের রূপ চাক্ষুস করতে লাগলেন অহরহ। পরিবারের ছজন মিলে মোটামুটি
ভদ্রস্থ রেস্তোঁরায় সপ্তাহান্তিক পানভোজনের বিল দিয়ে গাড়িতে উঠে খেয়াল পড়ে
সেই বিলের পরিমাণ বাইরে এতক্ষণ অপেক্ষমান চালকের মাসমাইনের অর্ধেক। খেয়াল
পড়ে প্রথম-প্রথম বার কয়েক বাড়ির পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোঁরায় বসে
খেলেও সে ঘটনা কমতে-কমতে শূন্যে এসে ঠেকেছে। সবথেকে যা ভয়াবহ, বুঝতে পারেন
শিশুকন্যাদ্বয় মার্ক্সসাহেবের তত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত না হয়েও শ্রেণী ও
শ্রেণীচরিত্র সম্বন্ধে প্র্যাক্টিকাল পাঠ হরবখত নিচ্ছে দৈনন্দিন
প্রাত্যহিকতা থেকে - একদল হুকুম করে, সে যতই মধুগুড় মাখান হুকুম হোক না কেন
এবং আর একদল সে হুকুম তামিল করে। জলধরবাবু সকাল-সন্ধ্যে "দীনবন্ধু, পার
করো" বলে কেঁদে ককিয়েও হালে পানি পান না।<br />
<br />
শিশুকালে স্কুলের প্রেয়ারে চেঁচিয়ে গেয়েছেন "বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান"।
কিন্তু সে মহান যে কী ভাবে দেখা যায় কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু জলধরবাবু এবার
দেখলেন। বেশ ভাল করেই দেখলেন। সাড়ে বত্তিরিশভাজা বিবিধ ভারতের মাঝে বলিউডি
মিলনের মাহাত্ম্য। রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে - সর্বত্র বলিউড। টিভিতে বলিউড।
রেডিওয় বলিউড। জামায় বলিউড। কাপড়ে বলিউড। সর্বভারতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায়
বলিউড। শিশুদের বিনোদনে বলিউড। জলধরবাবু খাবি খেলেন। খেয়ে মন দিয়ে মেয়েদের
সঙ্গে ছোটা ভীম দেখতে লাগলেন। তবে প্রযুক্তির কী মাহাত্ম্য! শুধু বলিউডই
নয়। খোদ কন্নড়ল্যান্ডে বসে প্রতি সন্ধ্যেয় গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন বাংলা
চ্যানেলের সিরিয়াল। যে সিরিয়ালে সবাই বাড়িতে পূর্ণ সেজে থাকে। সব পরিবারই
যৌথ। সব পরিবারেই কুচুটে লোকেরা অন্যকে প্রাণে মেরে দেবার চক্রান্ত চালিয়ে
যায় প্রতি সন্ধ্যেয়। সবারই ঘোরতর গুন্ডাদলের সঙ্গে খুব দহরম-মহরম চলে। বিষ
অতি সহজলভ্য।<br />
<br />
জলধরবাবু ঘামতে লাগলেন।<br />
<br />
<hr />
ঘামার সুযোগ জলধরবাবু বিশেষ পান না। একে ব্যঙ্গালোরের অতি মনোরম চির-বসন্ত
টাইপ আবহাওয়ায় ঘামার সুযোগ প্রায় পাওয়াই যায় না, তার ওপর জলধরবাবু যে
বুদবুদে বাসা নিয়েছেন সেখানে লোডশেডিং হলেই পাওয়ার ব্যাকাপ চালু হয়ে যায়
অতি দ্রুত। সে ব্যাকাপে রেফ্রিজারেটর চলে, মাইক্রোয়েভ চলে, টিভি চলে,
আলো-পাখা চলে, এসি চলে, গিজারও চলে বোধহয়। না চললে চলবেই বা কেন। লোডশেডিং
হয় বটে! মুহুর্মুহু। এই আছে , এই নেই। জলধরবাবুর সত্তর-আশির দশকের কলকাতায়
লোডশেডিং-এর সুবর্ণ যুগের কথা মনে পড়ে যায়। হায় সেই সব দিন। বুকের গভীর
থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জলধরবাবুর। কোথায় গেল সেই ঘরে ঘরে
লম্প-কুপি-হ্যারিকেনের দিনগুলি! রোজ সকালে লম্প-হ্যারিকেনের কাঁচ পরিস্কার
করার রুটিন ছিল। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো এসব কিছু শিখলই না!!<br />
<br />
কিন্তু জলধরবাবু শিখছেন। প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু শিখছেন। সব শেখাই যে নতুন
তা নয়। অনেক কিছুই ফিরিঙ্গি-কুসঙ্গে ভুলে গেছিলেন, এখন আবার ঝালাই হয়ে
যাচ্ছে। যেমন কেউই সময়ে আসে না। ফোন করলেই বলে "ইন ফাইভ মিনিট্স"। সবাই
মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আপিসের লোকেদের পরস্পরকে ফোন করা যায় যখন-তখন।
দোকানপাট-আপিস বিল্ডিং-রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স-সিনেমা
হল-হোটেল-রেস্টোর্যান্ট-শপিং মল - সর্বত্র গেটে সিকিউরিটি গার্ড। পোশাকের
কায়দা দেখে খানাতল্লাশি কতটা হবে তা স্থির হয়। গাড়ি নিয়ে ঢুকতে গেলে গাড়ির
ট্রাংক খুলে দেখান। কিন্তু ট্রাংকে সুটকেস-টুসকেস থাকলে সে সব খুলতে হয় না।
কাজেই যদি কোন কারণে আপনি সিকিউরিটির হাতে ধরা পড়তে চান, বোমা-টোমা
সুটকেসে রাখবেন না। পুরোন দিনের হিন্দি ছবিতে যেরকম দেখাত, সেই মতন বোমার
ওপরে ওপরে বড় বড় করে "বোমা" লিখে ট্রাংকে রেখে দেবেন।<br />
<br />
এবং মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অ্যামেরিকা-ফেরত জলধরবাবু এক
অনাস্বাদিত মুক্তির হাওয়া পেলেন। নিজের পয়সা দিয়ে কেনা জিনিস যে নিজস্ব হতে
পারে, অ্যামেরিকায় বসবাস করে এ ব্যাপার প্রায় ভুলতে বসেছিলেন।
নিজের-পয়সা-দিয়ে-কেনা কম্পিউটারে নিজের পছন্দের অপারেটিং সিস্টেম লাগাবেন?
হবে, যদি কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার অনুমতি দেয়। যে অপারেটিং সিস্টেম পয়সা
দিয়ে কিনেছেন, সেটিও আপনার নয়। কারণ আপনি তো কেনেননি, লাইসেন্স নিয়েছেন।
সার্ভিস প্রোভাইডার নামমাত্র দামে, সময়বিশেষে এমনকি বিনি পয়সায়, মোবাইল ফোন
দেয়। বদলে বন্ধক রাখতে হয় নিজের জিনিস নিজের করার স্বাধীনতাটি। তবে
স্মার্ট ফোনের রমরমা আসার পর শুনেছেন অব্স্থার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। অথচ
ভারতে? গটগট করে দোকানে ঢুকলেন জলধরবাবু, পয়সা দিলেন, নতুন ফোনে পেলেন।
সার্ভিস প্রোভাইডারের আপিস থেকে আগেই সিম কার্ডটি হস্তগত করে চালু করে
রেখেছিলেন। সে সিম কার্ডটি এবার স্বস্থানে বসালেন। ব্যস। এবার নিজ মাল নিজ
দায়িত্বে।<br />
<br />
সিম ভরার ঠিক সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে প্রথম কলটি এল। নিজের ফোনে প্রথম
নিজের কল। আহ্লাদে জলধরবাবু আটখানা। "হ্যালো"। "হ্যালো স্যার, দিস ইজ
সুনিধি ফ্রম অমুক ব্যংক। উই আর গিভিং পার্সোনাল লোন আপটু ফিফটি থাউজ্যান্ড
..."। জলধরবাবু বুঝলেন বিনামূল্যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। তার মূল্য
হাতে-হাতে চুকিয়ে দিতে হয়।<br />
<br />
যত সহজে সার্ভিস প্রোভাইডারের আপিস থেকে সিম কার্ড পাওয়ার কথা লেখা হল,
ইতিহাস বলে, কাঠখড় তার কিছু বেশিই পোড়াতে হয়েছিল। তার কারণ একটিই।
অ্যাড্রেস প্রুফ। এ গ্যাঁড়াকলে যে না ফেঁসেছে তার পক্ষে গর্দিশের অবস্থা
কল্পনা করা দুষ্কর। মোবাইল ফোনের অ্যাকাউন্ট করবেন? অ্যাড্রেস প্রুফ নিয়ে
আসুন। ল্যান্ডলাইনের সরকারি ফোন বিল, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স - সব
চলেগা। চলেগা তো, কিন্তু মিলেগা কোথায়? বাড়িই এখনও ভাড়া করেননি তো
ল্যান্ডলাইন! আর করলেও কোন দুঃখে সরকারি বিএসএনএল নেবেন? বেঁচে থাক
প্রাইভেট সেক্টর। আর পাসপোর্ট? সে তো বদল হয়ে গেছে। মার্কিন-নাগরিক
জলধরবাবু তো আক্ষরিক অর্থে নিজদেশে পরবাসী। বাকি রইল ড্রাইভিং লাইসেন্স।
কিন্তু সে করতে গেলেও তো অ্যাড্রেস প্রুফ লাগবে। কিরকম অ্যাড্রেস প্রুফ
চলবে? কেন বাড়ি ভাড়ার দলিল। ব্যস, সার্কল কমপ্লিট। যেখান থেকে শুরু
করেছিলেন, ফিনসে সেখানে। ক-য়ে কমললোচন ইত্যাদি। যাকগে, এ ব্যাপারে ফেনিয়ে
লাভ নেই। তবে অ্যাড্রেস প্রুফ ভারতে এক মহার্ঘ্য জিনিস। কিন্তু দাঁতের মতন।
যার আছে সে এর মর্যাদা বোঝে না। এর সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজ ছবিটিও ভুলবেন না।
ওটিরও চাহিদা প্রবল। সবাই ২০১১ সালে জলধরবাবু কেমন দেখতে ছিলেন তা
ডকুমেন্ট করে রাখতে চায়। কানাঘুষোয় এ-ও শুনেছেন যে সুলভ শৌচালয়ে "পয়সার
বিনিময় শৌচকর্ম" করতে গেলেও নাকি প্রতিবার একটি করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি জমা
করতে হবে।<br />
<br />
অতএব জলধরবাবু এখন সর্বদা পকেটে দুটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে ঘোরেন।<br />
<br />
জলধরবাবু স্বপ্ন দেখতেন দেশে ফিরে সকালে থলি দুলিয়ে বাজারে যাবেন। দরদাম
করে কিনে ফেলবেন টাটকা কাঁচকলা, সবুজ ঝিঙে, কচি পটল, নিদাগ বেগুণ, ঘাই-মারা
কই কী রক্তঝরা কাটাপোনা। তবে এ ভারত বাবা-কাকাদের আমলের ভারত নয়, এ হল
গিয়ে চকচকে ভারতবর্ষ। আর ব্যাঙ্গালোরও কলকাতা নয়। কাজেই থলি দুলিয়ে বাজার
যাওয়ার সময় পেলেন শুধু শনি-রবিবার। কিন্তু বাজার মানে বাজারই। ফিরিঙ্গি
হনুকরণের তারের গাড়িঠেলা সুপারমার্কেট নয়। এ হল ব্যাঙ্গালোরের ঐতিহ্যবাহী
হ্যাল মার্কেট। আগে নাকি বাঙালীর ছোটখাটো মিলনক্ষেত্র ছিল। এখনও আছে। এখানে
আসে অন্ধ্রের রুই, চট্টগ্রামের ইলিশ, কলকাতার কচুর-লতি থেকে চিংড়ি, ঝর্ণা
ঘি থেকে সানন্দা। রুই একশো ষাট, যদিও টোটাল ধরণের সুপারমার্কেটে একশো কুড়ি।
কারণ টোটালের মাছ লোকাল। ইলিশ সাতশো-আটশো গ্রামের বেশি ওজনের পাওয়াই যায়
না। পেলে হাজারের ওপর দাম। নইলে সাতশো-আটশো-নশো। ভেটকি সাড়ে তিনশো। বড়
চিংড়ি সাড়ে চারশো। তুলনামূলকভাবে চিংড়ির দামই গেল তিরিশ-চল্লিশ বছরে কম
বেড়েছে। প্রতিবার মাছ কিনে ফেরার সময়ে জলধরবাবু প্রতিজ্ঞা করেন পরিবারসুদ্ধ
ভাত আর বাটারমিল্ক ডায়েটে পরিবর্তিত হয়ে যাবেন। পরিবর্তনেরই তো বাজার। তার
ওপর ভাত-বাটারমিল্ক খেয়ে ভারতের আই-এ-এস ক্যাডার যদি ভর্তি করে ফেলা যায়
তো বাঙালির এত কি আম্বা যে মাছ না খেলে চলবে না!<br />
<br />
বলতে নেই, জলধরবাবু নোলাটি বেশ স্বাস্থ্যবান। আজ আরশোলার চচ্চড়ি খেয়ে
ফেললেন তো কাল জেলিফিশের মালাইকারি - এরকম দুঃসাহসী না হলেও, চেনাশোনা
খাবারের বড়সড় গন্ডির মধ্যে ঘোরাফেরা করে থাকেন। কলকাতা জলধরবাবুর স্বর্গ।
পাড়ার মোড়ের "কমলে কামিনী কাফে"র হাড়-সর্বস্ব কষা মাংসর যা সোয়াদ,
অ্যামেরিকার বাঘা-বাঘা নামের, জ্যাগাত কি মিশেলিন রেটেড দোকানও তার
ধারেকাছে আসতে পারে না। ব্যাঙ্গালোরে মোড়ের দোকানে বাঙালি কষা মাংস না
পাওয়া গেলেও, আপিসের মোড়ের অখ্যাত দোকানে যে তন্দুরি চিকেন বানাত, সে খেতে
দীর্ঘ পথ হাঁটতেও রাজি ছিলেন জলধরবাবু। তাছাড়া দেশে ফেরার মাস খানেকের
মধ্যে আবিষ্কার করে ফেললেন কোরামঙ্গলার আওধি খাবারের দোকান তুন্ডে কাবাবিতে
রুমালি রুটি আর তুন্ডে কাবাব। একদম লা-জবাব। খুঁজে পেলেন কলকাত্তাইয়া
লাজিজ ও আর্সালান - হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির থেকে মুখ বদল করতে কলকাতা-স্টাইল
বিরিয়ানি আর চিকেন টিক্কা গ্রেভি। হায়্দ্রাবাদী বিরিয়ানি খেতে চার্চ
স্ট্রীটের "সমরখন্দ", যা নামেই আফগান। আসলে উত্তরভারতীয় কাবাব, নল্লি আর
বিরিয়ানির ফার্স্ট ক্লাস ঠেক। হানা দিলেন ভারতে চলা প্রথম ট্রেনের থিমে
তৈরি রেস্তোঁরা "সাহিব-সিন্ধ-সুলতান"। এদের বিরিয়ানির খুব নাম থাকলেও
পুদিনাগন্ধী হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি জলধরবাবুর খুব পোষাল না, কিন্তু বাকি
খাবারদাবার দিব্যি ভাল। শিখে গেলেন মালায়লি দোকানে মাটন স্টু দিয়ে আপ্পম
খাবার রীতিনীতি। কাজেই আপাতত শান্তিকল্যাণ।<br />
<br />
অথচ বড় মুখ করে স্টেক খেতে গিয়ে খুব হেনস্থা হলেন যা হোক। ফাইবার সর্বস্ব
স্বাদহীন মাংসখন্ড। মিডিয়াম-রেয়ার চাইলেন, করে আনল চারকোল। ওয়েলডান চাইলে
মাংসর মধ্যবর্তীস্থান লাল ও ঠান্ডা। সর্বোপরি সব স্টেকের ওপরেই গ্রেভি
ঢালা। মেয়েদের স্প্যাগেটি-অ্যান্ড-মিটবল খাওয়াতে ব্যাঙ্গালোরের নামী
ইটালিয়ান রেস্তোঁরায় ঢুকে আবিষ্কার করলেন সেটি ভেজিটেরিয়ান ইটালিয়ান।
ন্যাকামো! জলকে যাব, বেণী ভিজাব না! মদও পাওয়া যায়না, তার বদলে মেলে
রঙবেরঙের শোভনদর্শন মকটেল। দক্ষিণ-ভারতীয় উচ্চকোটির ব্রাহ্মণেরও কৌলিন্য
যাবার কোন ভয় নেই। আবিষ্কার করে রোমাঞ্চিত হলেন ঠিকই, খাবারও খারাপ নয়,
কিন্তু খুব যে উৎসাহিত বোধ করলেন, এমন নয়। আর ততক্ষণে দেরি যা হবার হয়ে
গেছে। এবং কেরমে কেরমে আবিষ্কার করলেন দেশের বিজাতীয় খানাবিপণিগুলো কোন
কঠোর কঠিন কুইজিনত্ব রক্ষা করার ঠিকা ও দায় নেয় নি। কাজেই ইটালিয়ান
রেস্তোঁরায় পেতেই পারেন ফাহিতা, চিনে দোকানে পাবেনই পাবেন কোরিয়ান কিমচি ও
থাই টম ইয়ুম সুপ। জলধরবাবুও আজকাল নির্বিকারমুখে ইডলির সঙ্গে আলুদ্দম খেতে
পারেন, রসম দিয়ে ফ্রায়েড রাইস।<br />
<br />
কাজেই ব্যাঙ্গালোর দিব্যি জায়গা। শুধু সারাদিন মনে হয় একটি রাক্ষুসে
কনস্ট্রাকশান সাইটে বসে আছেন। বাতাসে সুরকির গন্ধ। বুটজুতোয় সিমেন্টের
ধুলো। বুদবুদ থেকে বেরোলেই চতুর্দিকে ঠং-ঠং ঘটঘট ধুপধাপ শব্দে বাড়ি হচ্ছে,
আপিস হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে, নতুন ব্রিজ বানানো চলছে। কিছুদিন এসব লক্ষ্য
করে জলধরবাবু খেয়াল করলেন যে এত সব যে এরা বানাচ্ছে, কেউ কিন্তু কোন নতুন
রাস্তা বানাবার দিকে নজর দিচ্ছে না। ফ্লাইওভারও যে হচ্ছে তাতে আন্ডারের
রাস্তা আর কার্যকরী রাস্তা থাকছে না। যদিও বা থাকে তবে অপেক্ষায় থাকছে
দুদিন বাদে মেট্রোর জন্যে লম্বা আখাম্বা থাম্বা এসে কবে তাকে আপন করে নেবে -
এই ভেবে। জলধরবাবু দাড়িটাড়ি চুলকে ভাবতে থাকেন, তবে ফ্লাইওভার বানিয়ে
রাস্তা উঁচু করা ছাড়া ঘোড়াড্ডিমের হলটা কী? এছাড়া এর বাড়ির দাওয়া, তার
বাড়ির উঠোনের ভেতর দিয়ে ভাঙাচোরা, প্রায়-নেই, চার-হাত চওড়া রাস্তা দিয়ে
যেতে যেতে দেখেন দুধারে প্রাক্তন চাষের জমিরা গ্রাম্য রূপ ছেড়ে সাহেবী
পোষাক পরছে - উঠছে হর্ম্যের পর হর্ম্য - যা কোটি কোটি টাকায় বিকোবে।
জলধরবাবু ভাবেন, এ সবই তো উন্নতি লক্ষণ। কিন্তু বাবাসকল, এই যে অট্টালিকা
বানাচ্ছ, এখানে এসে হাজারের কাছাকাছি লোক থাকবে একদিন - সেই অট্টালিকায়
পৌঁছতে তো হাতে হ্যারিকেন, প্যান্টুল ঢলঢলে ও গালে দাড়ি গজিয়ে যাবে! কিন্তু
কে শোনে কার কথা! মাঝে মাঝে মনে হয় চিৎকার করে বলেন, "বাপু হে, রাস্তাটা
ভুলো না।" কিছু কিছু কমপ্লেক্স তো শহর থেকে দূরত্বের কারণহেতু এবং
রাস্তাহীনতার কারণে প্ল্যানে হেলিপ্যাডের বন্দোবস্ত রেখেছে। এ কথা জলধরবাবু
নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে বেগ পেলেন।<br />
<br />
ব্যাঙ্গালোর আজব শহর। প্রাচ্যের সিলিকন ভ্যালি। নামকরা হুদো হুদো কোম্পানি
যেচে গিয়ে আপিস ফাঁদছে আর ট্যাক্সো দিচ্ছে। রাস্তায় আধুনিক কেতার লাখে
লাখে গাড়ি। অ্যামবাসেডরের মতন কুলীন গাড়ি রাস্তায় দেখাই যায় না।
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জিনিসের বিজ্ঞাপনে রাস্তা-বাড়ি-মানুষ সবেরই মুখ
ঢেকে যায়। রাস্তায় চলছে পেল্লায় ও আধুনিক বাস। সারি সারি দামী জিনিসের
চকচকে দোকানের মাঝে দুখীমুখে উঁকি মারে পাড়ার মনোহারী দোকান, মুদির দোকান,
চুল কাটার সেলুন, ছিটকাপড়ের দোকান। অথচ রাস্তার ধারে ওপেন ড্রেন। শহরজুড়েই।
এই একবিংশ শতাব্দীর শাইনিং ইন্ডিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হাইটেক
শহরে। এবং নোংরাস্য নোংরা নিষ্কাশনী খাল। আর বিষজল-ভরা লেক। সে লেকও
দেখ-তো-দেখ ময়লা-টয়লা ঢেলে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তারপরেই নীল করোগেটেড শিট
দিয়ে বাউন্ডারি ও বিল্ডারের সাইনবোর্ড - লেকভিউ অ্যাপার্টমেন্ট। ভিউ লেকে
আছে ঠিকই - যদিও কদ্দিন থাকবে বলা যাচ্ছে না কারণ অন্য বিল্ডাররাও তো সেই
একই লেক বুজিয়েই লেকভিস্তা, ওয়াটারফ্রন্ট, অ্যাকোয়াভিউ প্রভৃতি হর্ম্যসমূহ
বানাইতেছে। আরও যেটা বলা নেই সে হল বিষ জলের দুর্গন্ধ ও ঝাঁকে ঝাঁকে
মশককুলের আগমন ও বসতিস্থাপন। জলধরবাবু বোঝেন খুব শিগ্গিরই ব্যাঙ্গালোরে আর
কোন ওয়াটার বডি থাকবে না। দূরদূরান্ত থেকে ট্যাংকারে জল আসবে। রাস্তাও উবে
যাবে। থাকবে শুধু থিকথিকে, দলা দলা বহুতল হর্ম্য, অট্টালিকা ও সারণী।
রাস্তায় মেঘ নয়, গাভীর মতন চরবে হেলিকপ্টার।<br />
<br />
শেষের ভয়ংকর সেদিনের কথা ভেবে জলধরবাবু শিউরে উঠলেন।<br />
<br />
[প্রথম প্রকাশ, ২৫-শে অক্টোবর, ২০১৩ <a href="http://www.guruchandali.com/blog/2013/10/25/1382657543822.html#.VTBPqpNtH08" target="_blank">গুরুচন্ডালী ডট কম</a>]</div>
undefined<br />
<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
জলধরবাবু একজন পোড়-খাওয়া এন আর আই বা ভাপাভা ("ভারত-পালানো-ভারতীয়") । তাঁর
লেট-যৌবন-আর্লি-প্রৌঢ়ত্বে জলধরবাবু <a href="http://atikathan.blogspot.com/2010/07/blog-post.html" target="_blank">একটি মস্করামূলক প্রবন্ধ</a> লিখে
হালকা করে দেশে ফেরত যাবার মনোবাসনা ব্যক্ত করেছিলেন । দোষের মধ্যে তো এই ।
এই দেখেই আকাশের দেবতা মুচকি হাসিলেন । বলিলেন, "তোর ফেসবুক পোস্টিং ১০০১
বার শেয়ার না করাতেই বর দিলাম । যাবি তো যা ।" অতঃপর জলধরবাবু
বৌ-বাচ্চা-বাক্স-প্যাঁটরাসহ ভারতবর্ষে ল্যান্ড করলেন ও ধান-চালের পারস্পরিক
সম্পর্ক সম্বন্ধে অবহিত হলেন । সংবর্ধনার একটা ক্ষীণ আশা পালন করলেও মনে
মনে বুঝে গেছিলেন নাগরিক সংবর্ধনা হবে না । তবে কাছে দূরের আত্মীয়-বন্ধু কি
আর চোখ গোলগোল ও ছলছল করে তাঁর দেশে ফেরার একটা মূল্য দেবে না !<br />
<br />
সে গুড়ে বালি । ফিরে দেখলেন বাপে-খেদানো-মায়ে-তাড়ানো ভাপাভার দল পঙ্গপালের
মতন দেশে ফিরছে । সব বড় এয়ারপোর্ট হাওড়া স্টেশন । বিলেতফেরত উদ্বাস্তুতে
ভরে গেছে । সকলের চোখেই অন্য উদ্বাস্তুর পরিবারের প্রতি তাচ্ছিল্য ও উষ্মা,
"আরেক পিস কম্পিটিশন!" দেশোয়ালি বেরাদরদের চোখে ব্যঙ্গ, "সেই তো আবার ফিরে
এলি ! সাহেবরা রাখল না?" জলধরবাবু ব্যাঙ্গালোরে এক পিস চাকরি জোটালেন ।<br />
<br />
ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে জলধরবাবুর জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হল। উপলব্ধি করলেন যে
ভারতবর্ষকে ত্যজ্য করেছিলেন আর যে ভারতবর্ষকে ফের বরণ করলেন, তারা দুটি
আলাদা প্রাণী, আদতে এক হলেও। তার একটি কারণ যদি হয় মাঝে ষোল-সতেরো বছর
বিভিন্ন ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে যেতে যেতে নিয়ে এসেছে উদারীকরণের মনমোহনীয়া
চকসা, আর একটি কারণ হবে কলকাতা ও ব্যাঙ্গালোরের তফাত। আজকের ব্যাঙ্গালোর
যদি একবিংশ শতকের ভারতবর্ষ হয় তো ষোল বছর আগে কলকাতা তবে ঊনবিংশ শতকের
বর্মা।<br />
<br />
সদ্য-প্রস্ফুটিত জ্ঞানচক্ষু মেলে জলধরবাবু যা দেখলেন তা হল নিম্নরূপ -<br />
<br />
১। মধ্যবিত্তের সংসার চালানর জন্যে না-হলেই-নয় এমন জিনিসের দাম বেড়েছে ছ-সাত গুণ।<br />
২। না-হলেও-চলে-তবে-হলে-ভাল জিনিসের দাম বেড়েছে দশ-বারো গুণ।<br />
৩। আগে পাওয়া যেত না এমন বিলাস বস্তুতে বাজার ছেয়ে গিয়েছে, এবং সেসব জিনিসের হাতপোড়ানো দাম।<br />
৪। লোকের, জলধরবাবুর পরিচিত মানুষজনের, মাসমাইনে হরবখত লাখ-বেলাখ। প্রায়
সবাইকার গাড়ি আছে। পঁয়তিরিশের মধ্যে চাকুরেরা ফ্ল্যাট কিনে ফেলছেন।<br />
<br />
জলধরবাবু বাকরুদ্ধ হলেন।<br />
<br />
ক্রমে ধাতস্থ হয়ে উপলব্ধি করলেন ভারতবর্ষ আসলে এক নয়, বহু। নিজের বাড়িতেই
দুই ভারতবর্ষের রূপ চাক্ষুস করতে লাগলেন অহরহ। পরিবারের ছজন মিলে মোটামুটি
ভদ্রস্থ রেস্তোঁরায় সপ্তাহান্তিক পানভোজনের বিল দিয়ে গাড়িতে উঠে খেয়াল পড়ে
সেই বিলের পরিমাণ বাইরে এতক্ষণ অপেক্ষমান চালকের মাসমাইনের অর্ধেক। খেয়াল
পড়ে প্রথম-প্রথম বার কয়েক বাড়ির পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোঁরায় বসে
খেলেও সে ঘটনা কমতে-কমতে শূন্যে এসে ঠেকেছে। সবথেকে যা ভয়াবহ, বুঝতে পারেন
শিশুকন্যাদ্বয় মার্ক্সসাহেবের তত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত না হয়েও শ্রেণী ও
শ্রেণীচরিত্র সম্বন্ধে প্র্যাক্টিকাল পাঠ হরবখত নিচ্ছে দৈনন্দিন
প্রাত্যহিকতা থেকে - একদল হুকুম করে, সে যতই মধুগুড় মাখান হুকুম হোক না কেন
এবং আর একদল সে হুকুম তামিল করে। জলধরবাবু সকাল-সন্ধ্যে "দীনবন্ধু, পার
করো" বলে কেঁদে ককিয়েও হালে পানি পান না।<br />
<br />
শিশুকালে স্কুলের প্রেয়ারে চেঁচিয়ে গেয়েছেন "বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান"।
কিন্তু সে মহান যে কী ভাবে দেখা যায় কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু জলধরবাবু এবার
দেখলেন। বেশ ভাল করেই দেখলেন। সাড়ে বত্তিরিশভাজা বিবিধ ভারতের মাঝে বলিউডি
মিলনের মাহাত্ম্য। রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে - সর্বত্র বলিউড। টিভিতে বলিউড।
রেডিওয় বলিউড। জামায় বলিউড। কাপড়ে বলিউড। সর্বভারতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায়
বলিউড। শিশুদের বিনোদনে বলিউড। জলধরবাবু খাবি খেলেন। খেয়ে মন দিয়ে মেয়েদের
সঙ্গে ছোটা ভীম দেখতে লাগলেন। তবে প্রযুক্তির কী মাহাত্ম্য! শুধু বলিউডই
নয়। খোদ কন্নড়ল্যান্ডে বসে প্রতি সন্ধ্যেয় গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন বাংলা
চ্যানেলের সিরিয়াল। যে সিরিয়ালে সবাই বাড়িতে পূর্ণ সেজে থাকে। সব পরিবারই
যৌথ। সব পরিবারেই কুচুটে লোকেরা অন্যকে প্রাণে মেরে দেবার চক্রান্ত চালিয়ে
যায় প্রতি সন্ধ্যেয়। সবারই ঘোরতর গুন্ডাদলের সঙ্গে খুব দহরম-মহরম চলে। বিষ
অতি সহজলভ্য।<br />
<br />
জলধরবাবু ঘামতে লাগলেন।<br />
<br />
ঘামার সুযোগ জলধরবাবু বিশেষ পান না। একে ব্যঙ্গালোরের অতি মনোরম চির-বসন্ত
টাইপ আবহাওয়ায় ঘামার সুযোগ প্রায় পাওয়াই যায় না, তার ওপর জলধরবাবু যে
বুদবুদে বাসা নিয়েছেন সেখানে লোডশেডিং হলেই পাওয়ার ব্যাকাপ চালু হয়ে যায়
অতি দ্রুত। সে ব্যাকাপে রেফ্রিজারেটর চলে, মাইক্রোয়েভ চলে, টিভি চলে,
আলো-পাখা চলে, এসি চলে, গিজারও চলে বোধহয়। না চললে চলবেই বা কেন। লোডশেডিং
হয় বটে! মুহুর্মুহু। এই আছে , এই নেই। জলধরবাবুর সত্তর-আশির দশকের কলকাতায়
লোডশেডিং-এর সুবর্ণ যুগের কথা মনে পড়ে যায়। হায় সেই সব দিন। বুকের গভীর
থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জলধরবাবুর। কোথায় গেল সেই ঘরে ঘরে
লম্প-কুপি-হ্যারিকেনের দিনগুলি! রোজ সকালে লম্প-হ্যারিকেনের কাঁচ পরিস্কার
করার রুটিন ছিল। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো এসব কিছু শিখলই না!!<br />
<br />
কিন্তু জলধরবাবু শিখছেন। প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু শিখছেন। সব শেখাই যে নতুন
তা নয়। অনেক কিছুই ফিরিঙ্গি-কুসঙ্গে ভুলে গেছিলেন, এখন আবার ঝালাই হয়ে
যাচ্ছে। যেমন কেউই সময়ে আসে না। ফোন করলেই বলে "ইন ফাইভ মিনিট্স"। সবাই
মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আপিসের লোকেদের পরস্পরকে ফোন করা যায় যখন-তখন।
দোকানপাট-আপিস বিল্ডিং-রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স-সিনেমা
হল-হোটেল-রেস্টোর্যান্ট-শপিং মল - সর্বত্র গেটে সিকিউরিটি গার্ড। পোশাকের
কায়দা দেখে খানাতল্লাশি কতটা হবে তা স্থির হয়। গাড়ি নিয়ে ঢুকতে গেলে গাড়ির
ট্রাংক খুলে দেখান। কিন্তু ট্রাংকে সুটকেস-টুসকেস থাকলে সে সব খুলতে হয় না।
কাজেই যদি কোন কারণে আপনি সিকিউরিটির হাতে ধরা পড়তে চান, বোমা-টোমা
সুটকেসে রাখবেন না। পুরোন দিনের হিন্দি ছবিতে যেরকম দেখাত, সেই মতন বোমার
ওপরে ওপরে বড় বড় করে "বোমা" লিখে ট্রাংকে রেখে দেবেন।<br />
<br />
এবং মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অ্যামেরিকা-ফেরত জলধরবাবু এক
অনাস্বাদিত মুক্তির হাওয়া পেলেন। নিজের পয়সা দিয়ে কেনা জিনিস যে নিজস্ব হতে
পারে, অ্যামেরিকায় বসবাস করে এ ব্যাপার প্রায় ভুলতে বসেছিলেন।
নিজের-পয়সা-দিয়ে-কেনা কম্পিউটারে নিজের পছন্দের অপারেটিং সিস্টেম লাগাবেন?
হবে, যদি কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার অনুমতি দেয়। যে অপারেটিং সিস্টেম পয়সা
দিয়ে কিনেছেন, সেটিও আপনার নয়। কারণ আপনি তো কেনেননি, লাইসেন্স নিয়েছেন।
সার্ভিস প্রোভাইডার নামমাত্র দামে, সময়বিশেষে এমনকি বিনি পয়সায়, মোবাইল ফোন
দেয়। বদলে বন্ধক রাখতে হয় নিজের জিনিস নিজের করার স্বাধীনতাটি। তবে
স্মার্ট ফোনের রমরমা আসার পর শুনেছেন অব্স্থার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। অথচ
ভারতে? গটগট করে দোকানে ঢুকলেন জলধরবাবু, পয়সা দিলেন, নতুন ফোনে পেলেন।
সার্ভিস প্রোভাইডারের আপিস থেকে আগেই সিম কার্ডটি হস্তগত করে চালু করে
রেখেছিলেন। সে সিম কার্ডটি এবার স্বস্থানে বসালেন। ব্যস। এবার নিজ মাল নিজ
দায়িত্বে।<br />
<br />
সিম ভরার ঠিক সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে প্রথম কলটি এল। নিজের ফোনে প্রথম
নিজের কল। আহ্লাদে জলধরবাবু আটখানা। "হ্যালো"। "হ্যালো স্যার, দিস ইজ
সুনিধি ফ্রম অমুক ব্যংক। উই আর গিভিং পার্সোনাল লোন আপটু ফিফটি থাউজ্যান্ড
..."। জলধরবাবু বুঝলেন বিনামূল্যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। তার মূল্য
হাতে-হাতে চুকিয়ে দিতে হয়।<br />
<br />
যত সহজে সার্ভিস প্রোভাইডারের আপিস থেকে সিম কার্ড পাওয়ার কথা লেখা হল,
ইতিহাস বলে, কাঠখড় তার কিছু বেশিই পোড়াতে হয়েছিল। তার কারণ একটিই।
অ্যাড্রেস প্রুফ। এ গ্যাঁড়াকলে যে না ফেঁসেছে তার পক্ষে গর্দিশের অবস্থা
কল্পনা করা দুষ্কর। মোবাইল ফোনের অ্যাকাউন্ট করবেন? অ্যাড্রেস প্রুফ নিয়ে
আসুন। ল্যান্ডলাইনের সরকারি ফোন বিল, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স - সব
চলেগা। চলেগা তো, কিন্তু মিলেগা কোথায়? বাড়িই এখনও ভাড়া করেননি তো
ল্যান্ডলাইন! আর করলেও কোন দুঃখে সরকারি বিএসএনএল নেবেন? বেঁচে থাক
প্রাইভেট সেক্টর। আর পাসপোর্ট? সে তো বদল হয়ে গেছে। মার্কিন-নাগরিক
জলধরবাবু তো আক্ষরিক অর্থে নিজদেশে পরবাসী। বাকি রইল ড্রাইভিং লাইসেন্স।
কিন্তু সে করতে গেলেও তো অ্যাড্রেস প্রুফ লাগবে। কিরকম অ্যাড্রেস প্রুফ
চলবে? কেন বাড়ি ভাড়ার দলিল। ব্যস, সার্কল কমপ্লিট। যেখান থেকে শুরু
করেছিলেন, ফিনসে সেখানে। ক-য়ে কমললোচন ইত্যাদি। যাকগে, এ ব্যাপারে ফেনিয়ে
লাভ নেই। তবে অ্যাড্রেস প্রুফ ভারতে এক মহার্ঘ্য জিনিস। কিন্তু দাঁতের মতন।
যার আছে সে এর মর্যাদা বোঝে না। এর সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজ ছবিটিও ভুলবেন না।
ওটিরও চাহিদা প্রবল। সবাই ২০১১ সালে জলধরবাবু কেমন দেখতে ছিলেন তা
ডকুমেন্ট করে রাখতে চায়। কানাঘুষোয় এ-ও শুনেছেন যে সুলভ শৌচালয়ে "পয়সার
বিনিময় শৌচকর্ম" করতে গেলেও নাকি প্রতিবার একটি করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি জমা
করতে হবে।<br />
<br />
অতএব জলধরবাবু এখন সর্বদা পকেটে দুটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে ঘোরেন।<br />
<br />
জলধরবাবু স্বপ্ন দেখতেন দেশে ফিরে সকালে থলি দুলিয়ে বাজারে যাবেন। দরদাম
করে কিনে ফেলবেন টাটকা কাঁচকলা, সবুজ ঝিঙে, কচি পটল, নিদাগ বেগুণ, ঘাই-মারা
কই কী রক্তঝরা কাটাপোনা। তবে এ ভারত বাবা-কাকাদের আমলের ভারত নয়, এ হল
গিয়ে চকচকে ভারতবর্ষ। আর ব্যাঙ্গালোরও কলকাতা নয়। কাজেই থলি দুলিয়ে বাজার
যাওয়ার সময় পেলেন শুধু শনি-রবিবার। কিন্তু বাজার মানে বাজারই। ফিরিঙ্গি
হনুকরণের তারের গাড়িঠেলা সুপারমার্কেট নয়। এ হল ব্যাঙ্গালোরের ঐতিহ্যবাহী
হ্যাল মার্কেট। আগে নাকি বাঙালীর ছোটখাটো মিলনক্ষেত্র ছিল। এখনও আছে। এখানে
আসে অন্ধ্রের রুই, চট্টগ্রামের ইলিশ, কলকাতার কচুর-লতি থেকে চিংড়ি, ঝর্ণা
ঘি থেকে সানন্দা। রুই একশো ষাট, যদিও টোটাল ধরণের সুপারমার্কেটে একশো কুড়ি।
কারণ টোটালের মাছ লোকাল। ইলিশ সাতশো-আটশো গ্রামের বেশি ওজনের পাওয়াই যায়
না। পেলে হাজারের ওপর দাম। নইলে সাতশো-আটশো-নশো। ভেটকি সাড়ে তিনশো। বড়
চিংড়ি সাড়ে চারশো। তুলনামূলকভাবে চিংড়ির দামই গেল তিরিশ-চল্লিশ বছরে কম
বেড়েছে। প্রতিবার মাছ কিনে ফেরার সময়ে জলধরবাবু প্রতিজ্ঞা করেন পরিবারসুদ্ধ
ভাত আর বাটারমিল্ক ডায়েটে পরিবর্তিত হয়ে যাবেন। পরিবর্তনেরই তো বাজার। তার
ওপর ভাত-বাটারমিল্ক খেয়ে ভারতের আই-এ-এস ক্যাডার যদি ভর্তি করে ফেলা যায়
তো বাঙালির এত কি আম্বা যে মাছ না খেলে চলবে না!<br />
<br />
বলতে নেই, জলধরবাবু নোলাটি বেশ স্বাস্থ্যবান। আজ আরশোলার চচ্চড়ি খেয়ে
ফেললেন তো কাল জেলিফিশের মালাইকারি - এরকম দুঃসাহসী না হলেও, চেনাশোনা
খাবারের বড়সড় গন্ডির মধ্যে ঘোরাফেরা করে থাকেন। কলকাতা জলধরবাবুর স্বর্গ।
পাড়ার মোড়ের "কমলে কামিনী কাফে"র হাড়-সর্বস্ব কষা মাংসর যা সোয়াদ,
অ্যামেরিকার বাঘা-বাঘা নামের, জ্যাগাত কি মিশেলিন রেটেড দোকানও তার
ধারেকাছে আসতে পারে না। ব্যাঙ্গালোরে মোড়ের দোকানে বাঙালি কষা মাংস না
পাওয়া গেলেও, আপিসের মোড়ের অখ্যাত দোকানে যে তন্দুরি চিকেন বানাত, সে খেতে
দীর্ঘ পথ হাঁটতেও রাজি ছিলেন জলধরবাবু। তাছাড়া দেশে ফেরার মাস খানেকের
মধ্যে আবিষ্কার করে ফেললেন কোরামঙ্গলার আওধি খাবারের দোকান তুন্ডে কাবাবিতে
রুমালি রুটি আর তুন্ডে কাবাব। একদম লা-জবাব। খুঁজে পেলেন কলকাত্তাইয়া
লাজিজ ও আর্সালান - হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির থেকে মুখ বদল করতে কলকাতা-স্টাইল
বিরিয়ানি আর চিকেন টিক্কা গ্রেভি। হায়্দ্রাবাদী বিরিয়ানি খেতে চার্চ
স্ট্রীটের "সমরখন্দ", যা নামেই আফগান। আসলে উত্তরভারতীয় কাবাব, নল্লি আর
বিরিয়ানির ফার্স্ট ক্লাস ঠেক। হানা দিলেন ভারতে চলা প্রথম ট্রেনের থিমে
তৈরি রেস্তোঁরা "সাহিব-সিন্ধ-সুলতান"। এদের বিরিয়ানির খুব নাম থাকলেও
পুদিনাগন্ধী হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি জলধরবাবুর খুব পোষাল না, কিন্তু বাকি
খাবারদাবার দিব্যি ভাল। শিখে গেলেন মালায়লি দোকানে মাটন স্টু দিয়ে আপ্পম
খাবার রীতিনীতি। কাজেই আপাতত শান্তিকল্যাণ।<br />
<br />
অথচ বড় মুখ করে স্টেক খেতে গিয়ে খুব হেনস্থা হলেন যা হোক। ফাইবার সর্বস্ব
স্বাদহীন মাংসখন্ড। মিডিয়াম-রেয়ার চাইলেন, করে আনল চারকোল। ওয়েলডান চাইলে
মাংসর মধ্যবর্তীস্থান লাল ও ঠান্ডা। সর্বোপরি সব স্টেকের ওপরেই গ্রেভি
ঢালা। মেয়েদের স্প্যাগেটি-অ্যান্ড-মিটবল খাওয়াতে ব্যাঙ্গালোরের নামী
ইটালিয়ান রেস্তোঁরায় ঢুকে আবিষ্কার করলেন সেটি ভেজিটেরিয়ান ইটালিয়ান।
ন্যাকামো! জলকে যাব, বেণী ভিজাব না! মদও পাওয়া যায়না, তার বদলে মেলে
রঙবেরঙের শোভনদর্শন মকটেল। দক্ষিণ-ভারতীয় উচ্চকোটির ব্রাহ্মণেরও কৌলিন্য
যাবার কোন ভয় নেই। আবিষ্কার করে রোমাঞ্চিত হলেন ঠিকই, খাবারও খারাপ নয়,
কিন্তু খুব যে উৎসাহিত বোধ করলেন, এমন নয়। আর ততক্ষণে দেরি যা হবার হয়ে
গেছে। এবং কেরমে কেরমে আবিষ্কার করলেন দেশের বিজাতীয় খানাবিপণিগুলো কোন
কঠোর কঠিন কুইজিনত্ব রক্ষা করার ঠিকা ও দায় নেয় নি। কাজেই ইটালিয়ান
রেস্তোঁরায় পেতেই পারেন ফাহিতা, চিনে দোকানে পাবেনই পাবেন কোরিয়ান কিমচি ও
থাই টম ইয়ুম সুপ। জলধরবাবুও আজকাল নির্বিকারমুখে ইডলির সঙ্গে আলুদ্দম খেতে
পারেন, রসম দিয়ে ফ্রায়েড রাইস।<br />
<br />
কাজেই ব্যাঙ্গালোর দিব্যি জায়গা। শুধু সারাদিন মনে হয় একটি রাক্ষুসে
কনস্ট্রাকশান সাইটে বসে আছেন। বাতাসে সুরকির গন্ধ। বুটজুতোয় সিমেন্টের
ধুলো। বুদবুদ থেকে বেরোলেই চতুর্দিকে ঠং-ঠং ঘটঘট ধুপধাপ শব্দে বাড়ি হচ্ছে,
আপিস হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে, নতুন ব্রিজ বানানো চলছে। কিছুদিন এসব লক্ষ্য
করে জলধরবাবু খেয়াল করলেন যে এত সব যে এরা বানাচ্ছে, কেউ কিন্তু কোন নতুন
রাস্তা বানাবার দিকে নজর দিচ্ছে না। ফ্লাইওভারও যে হচ্ছে তাতে আন্ডারের
রাস্তা আর কার্যকরী রাস্তা থাকছে না। যদিও বা থাকে তবে অপেক্ষায় থাকছে
দুদিন বাদে মেট্রোর জন্যে লম্বা আখাম্বা থাম্বা এসে কবে তাকে আপন করে নেবে -
এই ভেবে। জলধরবাবু দাড়িটাড়ি চুলকে ভাবতে থাকেন, তবে ফ্লাইওভার বানিয়ে
রাস্তা উঁচু করা ছাড়া ঘোড়াড্ডিমের হলটা কী? এছাড়া এর বাড়ির দাওয়া, তার
বাড়ির উঠোনের ভেতর দিয়ে ভাঙাচোরা, প্রায়-নেই, চার-হাত চওড়া রাস্তা দিয়ে
যেতে যেতে দেখেন দুধারে প্রাক্তন চাষের জমিরা গ্রাম্য রূপ ছেড়ে সাহেবী
পোষাক পরছে - উঠছে হর্ম্যের পর হর্ম্য - যা কোটি কোটি টাকায় বিকোবে।
জলধরবাবু ভাবেন, এ সবই তো উন্নতি লক্ষণ। কিন্তু বাবাসকল, এই যে অট্টালিকা
বানাচ্ছ, এখানে এসে হাজারের কাছাকাছি লোক থাকবে একদিন - সেই অট্টালিকায়
পৌঁছতে তো হাতে হ্যারিকেন, প্যান্টুল ঢলঢলে ও গালে দাড়ি গজিয়ে যাবে! কিন্তু
কে শোনে কার কথা! মাঝে মাঝে মনে হয় চিৎকার করে বলেন, "বাপু হে, রাস্তাটা
ভুলো না।" কিছু কিছু কমপ্লেক্স তো শহর থেকে দূরত্বের কারণহেতু এবং
রাস্তাহীনতার কারণে প্ল্যানে হেলিপ্যাডের বন্দোবস্ত রেখেছে। এ কথা জলধরবাবু
নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে বেগ পেলেন।<br />
<br />
ব্যাঙ্গালোর আজব শহর। প্রাচ্যের সিলিকন ভ্যালি। নামকরা হুদো হুদো কোম্পানি
যেচে গিয়ে আপিস ফাঁদছে আর ট্যাক্সো দিচ্ছে। রাস্তায় আধুনিক কেতার লাখে
লাখে গাড়ি। অ্যামবাসেডরের মতন কুলীন গাড়ি রাস্তায় দেখাই যায় না।
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জিনিসের বিজ্ঞাপনে রাস্তা-বাড়ি-মানুষ সবেরই মুখ
ঢেকে যায়। রাস্তায় চলছে পেল্লায় ও আধুনিক বাস। সারি সারি দামী জিনিসের
চকচকে দোকানের মাঝে দুখীমুখে উঁকি মারে পাড়ার মনোহারী দোকান, মুদির দোকান,
চুল কাটার সেলুন, ছিটকাপড়ের দোকান। অথচ রাস্তার ধারে ওপেন ড্রেন। শহরজুড়েই।
এই একবিংশ শতাব্দীর শাইনিং ইন্ডিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হাইটেক
শহরে। এবং নোংরাস্য নোংরা নিষ্কাশনী খাল। আর বিষজল-ভরা লেক। সে লেকও
দেখ-তো-দেখ ময়লা-টয়লা ঢেলে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তারপরেই নীল করোগেটেড শিট
দিয়ে বাউন্ডারি ও বিল্ডারের সাইনবোর্ড - লেকভিউ অ্যাপার্টমেন্ট। ভিউ লেকে
আছে ঠিকই - যদিও কদ্দিন থাকবে বলা যাচ্ছে না কারণ অন্য বিল্ডাররাও তো সেই
একই লেক বুজিয়েই লেকভিস্তা, ওয়াটারফ্রন্ট, অ্যাকোয়াভিউ প্রভৃতি হর্ম্যসমূহ
বানাইতেছে। আরও যেটা বলা নেই সে হল বিষ জলের দুর্গন্ধ ও ঝাঁকে ঝাঁকে
মশককুলের আগমন ও বসতিস্থাপন। জলধরবাবু বোঝেন খুব শিগ্গিরই ব্যাঙ্গালোরে আর
কোন ওয়াটার বডি থাকবে না। দূরদূরান্ত থেকে ট্যাংকারে জল আসবে। রাস্তাও উবে
যাবে। থাকবে শুধু থিকথিকে, দলা দলা বহুতল হর্ম্য, অট্টালিকা ও সারণী।
রাস্তায় মেঘ নয়, গাভীর মতন চরবে হেলিকপ্টার।<br />
<br />
শেষের ভয়ংকর সেদিনের কথা ভেবে জলধরবাবু শিউরে উঠলেন।<br />
<br />
[প্রথম প্রকাশ, ২৫-শে অক্টোবর, ২০১৩ <a href="http://www.guruchandali.com/blog/2013/10/25/1382657543822.html#.VTBPqpNtH08" target="_blank">গুরুচন্ডালী ডট কম</a>]</div>
undefined<br />
<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
জলধরবাবু একজন পোড়-খাওয়া এন আর আই বা ভাপাভা ("ভারত-পালানো-ভারতীয়") । তাঁর
লেট-যৌবন-আর্লি-প্রৌঢ়ত্বে জলধরবাবু <a href="http://atikathan.blogspot.com/2010/07/blog-post.html" target="_blank">একটি মস্করামূলক প্রবন্ধ</a> লিখে
হালকা করে দেশে ফেরত যাবার মনোবাসনা ব্যক্ত করেছিলেন । দোষের মধ্যে তো এই ।
এই দেখেই আকাশের দেবতা মুচকি হাসিলেন । বলিলেন, "তোর ফেসবুক পোস্টিং ১০০১
বার শেয়ার না করাতেই বর দিলাম । যাবি তো যা ।" অতঃপর জলধরবাবু
বৌ-বাচ্চা-বাক্স-প্যাঁটরাসহ ভারতবর্ষে ল্যান্ড করলেন ও ধান-চালের পারস্পরিক
সম্পর্ক সম্বন্ধে অবহিত হলেন । সংবর্ধনার একটা ক্ষীণ আশা পালন করলেও মনে
মনে বুঝে গেছিলেন নাগরিক সংবর্ধনা হবে না । তবে কাছে দূরের আত্মীয়-বন্ধু কি
আর চোখ গোলগোল ও ছলছল করে তাঁর দেশে ফেরার একটা মূল্য দেবে না !<br />
<br />
সে গুড়ে বালি । ফিরে দেখলেন বাপে-খেদানো-মায়ে-তাড়ানো ভাপাভার দল পঙ্গপালের
মতন দেশে ফিরছে । সব বড় এয়ারপোর্ট হাওড়া স্টেশন । বিলেতফেরত উদ্বাস্তুতে
ভরে গেছে । সকলের চোখেই অন্য উদ্বাস্তুর পরিবারের প্রতি তাচ্ছিল্য ও উষ্মা,
"আরেক পিস কম্পিটিশন!" দেশোয়ালি বেরাদরদের চোখে ব্যঙ্গ, "সেই তো আবার ফিরে
এলি ! সাহেবরা রাখল না?" জলধরবাবু ব্যাঙ্গালোরে এক পিস চাকরি জোটালেন ।<br />
<br />
ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে জলধরবাবুর জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হল। উপলব্ধি করলেন যে
ভারতবর্ষকে ত্যজ্য করেছিলেন আর যে ভারতবর্ষকে ফের বরণ করলেন, তারা দুটি
আলাদা প্রাণী, আদতে এক হলেও। তার একটি কারণ যদি হয় মাঝে ষোল-সতেরো বছর
বিভিন্ন ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে যেতে যেতে নিয়ে এসেছে উদারীকরণের মনমোহনীয়া
চকসা, আর একটি কারণ হবে কলকাতা ও ব্যাঙ্গালোরের তফাত। আজকের ব্যাঙ্গালোর
যদি একবিংশ শতকের ভারতবর্ষ হয় তো ষোল বছর আগে কলকাতা তবে ঊনবিংশ শতকের
বর্মা।<br />
<br />
সদ্য-প্রস্ফুটিত জ্ঞানচক্ষু মেলে জলধরবাবু যা দেখলেন তা হল নিম্নরূপ -<br />
<br />
১। মধ্যবিত্তের সংসার চালানর জন্যে না-হলেই-নয় এমন জিনিসের দাম বেড়েছে ছ-সাত গুণ।<br />
২। না-হলেও-চলে-তবে-হলে-ভাল জিনিসের দাম বেড়েছে দশ-বারো গুণ।<br />
৩। আগে পাওয়া যেত না এমন বিলাস বস্তুতে বাজার ছেয়ে গিয়েছে, এবং সেসব জিনিসের হাতপোড়ানো দাম।<br />
৪। লোকের, জলধরবাবুর পরিচিত মানুষজনের, মাসমাইনে হরবখত লাখ-বেলাখ। প্রায়
সবাইকার গাড়ি আছে। পঁয়তিরিশের মধ্যে চাকুরেরা ফ্ল্যাট কিনে ফেলছেন।<br />
<br />
জলধরবাবু বাকরুদ্ধ হলেন।<br />
<br />
ক্রমে ধাতস্থ হয়ে উপলব্ধি করলেন ভারতবর্ষ আসলে এক নয়, বহু। নিজের বাড়িতেই
দুই ভারতবর্ষের রূপ চাক্ষুস করতে লাগলেন অহরহ। পরিবারের ছজন মিলে মোটামুটি
ভদ্রস্থ রেস্তোঁরায় সপ্তাহান্তিক পানভোজনের বিল দিয়ে গাড়িতে উঠে খেয়াল পড়ে
সেই বিলের পরিমাণ বাইরে এতক্ষণ অপেক্ষমান চালকের মাসমাইনের অর্ধেক। খেয়াল
পড়ে প্রথম-প্রথম বার কয়েক বাড়ির পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোঁরায় বসে
খেলেও সে ঘটনা কমতে-কমতে শূন্যে এসে ঠেকেছে। সবথেকে যা ভয়াবহ, বুঝতে পারেন
শিশুকন্যাদ্বয় মার্ক্সসাহেবের তত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত না হয়েও শ্রেণী ও
শ্রেণীচরিত্র সম্বন্ধে প্র্যাক্টিকাল পাঠ হরবখত নিচ্ছে দৈনন্দিন
প্রাত্যহিকতা থেকে - একদল হুকুম করে, সে যতই মধুগুড় মাখান হুকুম হোক না কেন
এবং আর একদল সে হুকুম তামিল করে। জলধরবাবু সকাল-সন্ধ্যে "দীনবন্ধু, পার
করো" বলে কেঁদে ককিয়েও হালে পানি পান না।<br />
<br />
শিশুকালে স্কুলের প্রেয়ারে চেঁচিয়ে গেয়েছেন "বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান"।
কিন্তু সে মহান যে কী ভাবে দেখা যায় কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু জলধরবাবু এবার
দেখলেন। বেশ ভাল করেই দেখলেন। সাড়ে বত্তিরিশভাজা বিবিধ ভারতের মাঝে বলিউডি
মিলনের মাহাত্ম্য। রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে - সর্বত্র বলিউড। টিভিতে বলিউড।
রেডিওয় বলিউড। জামায় বলিউড। কাপড়ে বলিউড। সর্বভারতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায়
বলিউড। শিশুদের বিনোদনে বলিউড। জলধরবাবু খাবি খেলেন। খেয়ে মন দিয়ে মেয়েদের
সঙ্গে ছোটা ভীম দেখতে লাগলেন। তবে প্রযুক্তির কী মাহাত্ম্য! শুধু বলিউডই
নয়। খোদ কন্নড়ল্যান্ডে বসে প্রতি সন্ধ্যেয় গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন বাংলা
চ্যানেলের সিরিয়াল। যে সিরিয়ালে সবাই বাড়িতে পূর্ণ সেজে থাকে। সব পরিবারই
যৌথ। সব পরিবারেই কুচুটে লোকেরা অন্যকে প্রাণে মেরে দেবার চক্রান্ত চালিয়ে
যায় প্রতি সন্ধ্যেয়। সবারই ঘোরতর গুন্ডাদলের সঙ্গে খুব দহরম-মহরম চলে। বিষ
অতি সহজলভ্য।<br />
<br />
জলধরবাবু ঘামতে লাগলেন।<br />
<br />
<hr />
ঘামার সুযোগ জলধরবাবু বিশেষ পান না। একে ব্যঙ্গালোরের অতি মনোরম চির-বসন্ত
টাইপ আবহাওয়ায় ঘামার সুযোগ প্রায় পাওয়াই যায় না, তার ওপর জলধরবাবু যে
বুদবুদে বাসা নিয়েছেন সেখানে লোডশেডিং হলেই পাওয়ার ব্যাকাপ চালু হয়ে যায়
অতি দ্রুত। সে ব্যাকাপে রেফ্রিজারেটর চলে, মাইক্রোয়েভ চলে, টিভি চলে,
আলো-পাখা চলে, এসি চলে, গিজারও চলে বোধহয়। না চললে চলবেই বা কেন। লোডশেডিং
হয় বটে! মুহুর্মুহু। এই আছে , এই নেই। জলধরবাবুর সত্তর-আশির দশকের কলকাতায়
লোডশেডিং-এর সুবর্ণ যুগের কথা মনে পড়ে যায়। হায় সেই সব দিন। বুকের গভীর
থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জলধরবাবুর। কোথায় গেল সেই ঘরে ঘরে
লম্প-কুপি-হ্যারিকেনের দিনগুলি! রোজ সকালে লম্প-হ্যারিকেনের কাঁচ পরিস্কার
করার রুটিন ছিল। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো এসব কিছু শিখলই না!!<br />
<br />
কিন্তু জলধরবাবু শিখছেন। প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু শিখছেন। সব শেখাই যে নতুন
তা নয়। অনেক কিছুই ফিরিঙ্গি-কুসঙ্গে ভুলে গেছিলেন, এখন আবার ঝালাই হয়ে
যাচ্ছে। যেমন কেউই সময়ে আসে না। ফোন করলেই বলে "ইন ফাইভ মিনিট্স"। সবাই
মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আপিসের লোকেদের পরস্পরকে ফোন করা যায় যখন-তখন।
দোকানপাট-আপিস বিল্ডিং-রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স-সিনেমা
হল-হোটেল-রেস্টোর্যান্ট-শপিং মল - সর্বত্র গেটে সিকিউরিটি গার্ড। পোশাকের
কায়দা দেখে খানাতল্লাশি কতটা হবে তা স্থির হয়। গাড়ি নিয়ে ঢুকতে গেলে গাড়ির
ট্রাংক খুলে দেখান। কিন্তু ট্রাংকে সুটকেস-টুসকেস থাকলে সে সব খুলতে হয় না।
কাজেই যদি কোন কারণে আপনি সিকিউরিটির হাতে ধরা পড়তে চান, বোমা-টোমা
সুটকেসে রাখবেন না। পুরোন দিনের হিন্দি ছবিতে যেরকম দেখাত, সেই মতন বোমার
ওপরে ওপরে বড় বড় করে "বোমা" লিখে ট্রাংকে রেখে দেবেন।<br />
<br />
এবং মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অ্যামেরিকা-ফেরত জলধরবাবু এক
অনাস্বাদিত মুক্তির হাওয়া পেলেন। নিজের পয়সা দিয়ে কেনা জিনিস যে নিজস্ব হতে
পারে, অ্যামেরিকায় বসবাস করে এ ব্যাপার প্রায় ভুলতে বসেছিলেন।
নিজের-পয়সা-দিয়ে-কেনা কম্পিউটারে নিজের পছন্দের অপারেটিং সিস্টেম লাগাবেন?
হবে, যদি কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার অনুমতি দেয়। যে অপারেটিং সিস্টেম পয়সা
দিয়ে কিনেছেন, সেটিও আপনার নয়। কারণ আপনি তো কেনেননি, লাইসেন্স নিয়েছেন।
সার্ভিস প্রোভাইডার নামমাত্র দামে, সময়বিশেষে এমনকি বিনি পয়সায়, মোবাইল ফোন
দেয়। বদলে বন্ধক রাখতে হয় নিজের জিনিস নিজের করার স্বাধীনতাটি। তবে
স্মার্ট ফোনের রমরমা আসার পর শুনেছেন অব্স্থার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। অথচ
ভারতে? গটগট করে দোকানে ঢুকলেন জলধরবাবু, পয়সা দিলেন, নতুন ফোনে পেলেন।
সার্ভিস প্রোভাইডারের আপিস থেকে আগেই সিম কার্ডটি হস্তগত করে চালু করে
রেখেছিলেন। সে সিম কার্ডটি এবার স্বস্থানে বসালেন। ব্যস। এবার নিজ মাল নিজ
দায়িত্বে।<br />
<br />
সিম ভরার ঠিক সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে প্রথম কলটি এল। নিজের ফোনে প্রথম
নিজের কল। আহ্লাদে জলধরবাবু আটখানা। "হ্যালো"। "হ্যালো স্যার, দিস ইজ
সুনিধি ফ্রম অমুক ব্যংক। উই আর গিভিং পার্সোনাল লোন আপটু ফিফটি থাউজ্যান্ড
..."। জলধরবাবু বুঝলেন বিনামূল্যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। তার মূল্য
হাতে-হাতে চুকিয়ে দিতে হয়।<br />
<br />
যত সহজে সার্ভিস প্রোভাইডারের আপিস থেকে সিম কার্ড পাওয়ার কথা লেখা হল,
ইতিহাস বলে, কাঠখড় তার কিছু বেশিই পোড়াতে হয়েছিল। তার কারণ একটিই।
অ্যাড্রেস প্রুফ। এ গ্যাঁড়াকলে যে না ফেঁসেছে তার পক্ষে গর্দিশের অবস্থা
কল্পনা করা দুষ্কর। মোবাইল ফোনের অ্যাকাউন্ট করবেন? অ্যাড্রেস প্রুফ নিয়ে
আসুন। ল্যান্ডলাইনের সরকারি ফোন বিল, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স - সব
চলেগা। চলেগা তো, কিন্তু মিলেগা কোথায়? বাড়িই এখনও ভাড়া করেননি তো
ল্যান্ডলাইন! আর করলেও কোন দুঃখে সরকারি বিএসএনএল নেবেন? বেঁচে থাক
প্রাইভেট সেক্টর। আর পাসপোর্ট? সে তো বদল হয়ে গেছে। মার্কিন-নাগরিক
জলধরবাবু তো আক্ষরিক অর্থে নিজদেশে পরবাসী। বাকি রইল ড্রাইভিং লাইসেন্স।
কিন্তু সে করতে গেলেও তো অ্যাড্রেস প্রুফ লাগবে। কিরকম অ্যাড্রেস প্রুফ
চলবে? কেন বাড়ি ভাড়ার দলিল। ব্যস, সার্কল কমপ্লিট। যেখান থেকে শুরু
করেছিলেন, ফিনসে সেখানে। ক-য়ে কমললোচন ইত্যাদি। যাকগে, এ ব্যাপারে ফেনিয়ে
লাভ নেই। তবে অ্যাড্রেস প্রুফ ভারতে এক মহার্ঘ্য জিনিস। কিন্তু দাঁতের মতন।
যার আছে সে এর মর্যাদা বোঝে না। এর সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজ ছবিটিও ভুলবেন না।
ওটিরও চাহিদা প্রবল। সবাই ২০১১ সালে জলধরবাবু কেমন দেখতে ছিলেন তা
ডকুমেন্ট করে রাখতে চায়। কানাঘুষোয় এ-ও শুনেছেন যে সুলভ শৌচালয়ে "পয়সার
বিনিময় শৌচকর্ম" করতে গেলেও নাকি প্রতিবার একটি করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি জমা
করতে হবে।<br />
<br />
অতএব জলধরবাবু এখন সর্বদা পকেটে দুটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে ঘোরেন।<br />
<br />
জলধরবাবু স্বপ্ন দেখতেন দেশে ফিরে সকালে থলি দুলিয়ে বাজারে যাবেন। দরদাম
করে কিনে ফেলবেন টাটকা কাঁচকলা, সবুজ ঝিঙে, কচি পটল, নিদাগ বেগুণ, ঘাই-মারা
কই কী রক্তঝরা কাটাপোনা। তবে এ ভারত বাবা-কাকাদের আমলের ভারত নয়, এ হল
গিয়ে চকচকে ভারতবর্ষ। আর ব্যাঙ্গালোরও কলকাতা নয়। কাজেই থলি দুলিয়ে বাজার
যাওয়ার সময় পেলেন শুধু শনি-রবিবার। কিন্তু বাজার মানে বাজারই। ফিরিঙ্গি
হনুকরণের তারের গাড়িঠেলা সুপারমার্কেট নয়। এ হল ব্যাঙ্গালোরের ঐতিহ্যবাহী
হ্যাল মার্কেট। আগে নাকি বাঙালীর ছোটখাটো মিলনক্ষেত্র ছিল। এখনও আছে। এখানে
আসে অন্ধ্রের রুই, চট্টগ্রামের ইলিশ, কলকাতার কচুর-লতি থেকে চিংড়ি, ঝর্ণা
ঘি থেকে সানন্দা। রুই একশো ষাট, যদিও টোটাল ধরণের সুপারমার্কেটে একশো কুড়ি।
কারণ টোটালের মাছ লোকাল। ইলিশ সাতশো-আটশো গ্রামের বেশি ওজনের পাওয়াই যায়
না। পেলে হাজারের ওপর দাম। নইলে সাতশো-আটশো-নশো। ভেটকি সাড়ে তিনশো। বড়
চিংড়ি সাড়ে চারশো। তুলনামূলকভাবে চিংড়ির দামই গেল তিরিশ-চল্লিশ বছরে কম
বেড়েছে। প্রতিবার মাছ কিনে ফেরার সময়ে জলধরবাবু প্রতিজ্ঞা করেন পরিবারসুদ্ধ
ভাত আর বাটারমিল্ক ডায়েটে পরিবর্তিত হয়ে যাবেন। পরিবর্তনেরই তো বাজার। তার
ওপর ভাত-বাটারমিল্ক খেয়ে ভারতের আই-এ-এস ক্যাডার যদি ভর্তি করে ফেলা যায়
তো বাঙালির এত কি আম্বা যে মাছ না খেলে চলবে না!<br />
<br />
বলতে নেই, জলধরবাবু নোলাটি বেশ স্বাস্থ্যবান। আজ আরশোলার চচ্চড়ি খেয়ে
ফেললেন তো কাল জেলিফিশের মালাইকারি - এরকম দুঃসাহসী না হলেও, চেনাশোনা
খাবারের বড়সড় গন্ডির মধ্যে ঘোরাফেরা করে থাকেন। কলকাতা জলধরবাবুর স্বর্গ।
পাড়ার মোড়ের "কমলে কামিনী কাফে"র হাড়-সর্বস্ব কষা মাংসর যা সোয়াদ,
অ্যামেরিকার বাঘা-বাঘা নামের, জ্যাগাত কি মিশেলিন রেটেড দোকানও তার
ধারেকাছে আসতে পারে না। ব্যাঙ্গালোরে মোড়ের দোকানে বাঙালি কষা মাংস না
পাওয়া গেলেও, আপিসের মোড়ের অখ্যাত দোকানে যে তন্দুরি চিকেন বানাত, সে খেতে
দীর্ঘ পথ হাঁটতেও রাজি ছিলেন জলধরবাবু। তাছাড়া দেশে ফেরার মাস খানেকের
মধ্যে আবিষ্কার করে ফেললেন কোরামঙ্গলার আওধি খাবারের দোকান তুন্ডে কাবাবিতে
রুমালি রুটি আর তুন্ডে কাবাব। একদম লা-জবাব। খুঁজে পেলেন কলকাত্তাইয়া
লাজিজ ও আর্সালান - হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির থেকে মুখ বদল করতে কলকাতা-স্টাইল
বিরিয়ানি আর চিকেন টিক্কা গ্রেভি। হায়্দ্রাবাদী বিরিয়ানি খেতে চার্চ
স্ট্রীটের "সমরখন্দ", যা নামেই আফগান। আসলে উত্তরভারতীয় কাবাব, নল্লি আর
বিরিয়ানির ফার্স্ট ক্লাস ঠেক। হানা দিলেন ভারতে চলা প্রথম ট্রেনের থিমে
তৈরি রেস্তোঁরা "সাহিব-সিন্ধ-সুলতান"। এদের বিরিয়ানির খুব নাম থাকলেও
পুদিনাগন্ধী হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি জলধরবাবুর খুব পোষাল না, কিন্তু বাকি
খাবারদাবার দিব্যি ভাল। শিখে গেলেন মালায়লি দোকানে মাটন স্টু দিয়ে আপ্পম
খাবার রীতিনীতি। কাজেই আপাতত শান্তিকল্যাণ।<br />
<br />
অথচ বড় মুখ করে স্টেক খেতে গিয়ে খুব হেনস্থা হলেন যা হোক। ফাইবার সর্বস্ব
স্বাদহীন মাংসখন্ড। মিডিয়াম-রেয়ার চাইলেন, করে আনল চারকোল। ওয়েলডান চাইলে
মাংসর মধ্যবর্তীস্থান লাল ও ঠান্ডা। সর্বোপরি সব স্টেকের ওপরেই গ্রেভি
ঢালা। মেয়েদের স্প্যাগেটি-অ্যান্ড-মিটবল খাওয়াতে ব্যাঙ্গালোরের নামী
ইটালিয়ান রেস্তোঁরায় ঢুকে আবিষ্কার করলেন সেটি ভেজিটেরিয়ান ইটালিয়ান।
ন্যাকামো! জলকে যাব, বেণী ভিজাব না! মদও পাওয়া যায়না, তার বদলে মেলে
রঙবেরঙের শোভনদর্শন মকটেল। দক্ষিণ-ভারতীয় উচ্চকোটির ব্রাহ্মণেরও কৌলিন্য
যাবার কোন ভয় নেই। আবিষ্কার করে রোমাঞ্চিত হলেন ঠিকই, খাবারও খারাপ নয়,
কিন্তু খুব যে উৎসাহিত বোধ করলেন, এমন নয়। আর ততক্ষণে দেরি যা হবার হয়ে
গেছে। এবং কেরমে কেরমে আবিষ্কার করলেন দেশের বিজাতীয় খানাবিপণিগুলো কোন
কঠোর কঠিন কুইজিনত্ব রক্ষা করার ঠিকা ও দায় নেয় নি। কাজেই ইটালিয়ান
রেস্তোঁরায় পেতেই পারেন ফাহিতা, চিনে দোকানে পাবেনই পাবেন কোরিয়ান কিমচি ও
থাই টম ইয়ুম সুপ। জলধরবাবুও আজকাল নির্বিকারমুখে ইডলির সঙ্গে আলুদ্দম খেতে
পারেন, রসম দিয়ে ফ্রায়েড রাইস।<br />
<br />
কাজেই ব্যাঙ্গালোর দিব্যি জায়গা। শুধু সারাদিন মনে হয় একটি রাক্ষুসে
কনস্ট্রাকশান সাইটে বসে আছেন। বাতাসে সুরকির গন্ধ। বুটজুতোয় সিমেন্টের
ধুলো। বুদবুদ থেকে বেরোলেই চতুর্দিকে ঠং-ঠং ঘটঘট ধুপধাপ শব্দে বাড়ি হচ্ছে,
আপিস হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে, নতুন ব্রিজ বানানো চলছে। কিছুদিন এসব লক্ষ্য
করে জলধরবাবু খেয়াল করলেন যে এত সব যে এরা বানাচ্ছে, কেউ কিন্তু কোন নতুন
রাস্তা বানাবার দিকে নজর দিচ্ছে না। ফ্লাইওভারও যে হচ্ছে তাতে আন্ডারের
রাস্তা আর কার্যকরী রাস্তা থাকছে না। যদিও বা থাকে তবে অপেক্ষায় থাকছে
দুদিন বাদে মেট্রোর জন্যে লম্বা আখাম্বা থাম্বা এসে কবে তাকে আপন করে নেবে -
এই ভেবে। জলধরবাবু দাড়িটাড়ি চুলকে ভাবতে থাকেন, তবে ফ্লাইওভার বানিয়ে
রাস্তা উঁচু করা ছাড়া ঘোড়াড্ডিমের হলটা কী? এছাড়া এর বাড়ির দাওয়া, তার
বাড়ির উঠোনের ভেতর দিয়ে ভাঙাচোরা, প্রায়-নেই, চার-হাত চওড়া রাস্তা দিয়ে
যেতে যেতে দেখেন দুধারে প্রাক্তন চাষের জমিরা গ্রাম্য রূপ ছেড়ে সাহেবী
পোষাক পরছে - উঠছে হর্ম্যের পর হর্ম্য - যা কোটি কোটি টাকায় বিকোবে।
জলধরবাবু ভাবেন, এ সবই তো উন্নতি লক্ষণ। কিন্তু বাবাসকল, এই যে অট্টালিকা
বানাচ্ছ, এখানে এসে হাজারের কাছাকাছি লোক থাকবে একদিন - সেই অট্টালিকায়
পৌঁছতে তো হাতে হ্যারিকেন, প্যান্টুল ঢলঢলে ও গালে দাড়ি গজিয়ে যাবে! কিন্তু
কে শোনে কার কথা! মাঝে মাঝে মনে হয় চিৎকার করে বলেন, "বাপু হে, রাস্তাটা
ভুলো না।" কিছু কিছু কমপ্লেক্স তো শহর থেকে দূরত্বের কারণহেতু এবং
রাস্তাহীনতার কারণে প্ল্যানে হেলিপ্যাডের বন্দোবস্ত রেখেছে। এ কথা জলধরবাবু
নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে বেগ পেলেন।<br />
<br />
ব্যাঙ্গালোর আজব শহর। প্রাচ্যের সিলিকন ভ্যালি। নামকরা হুদো হুদো কোম্পানি
যেচে গিয়ে আপিস ফাঁদছে আর ট্যাক্সো দিচ্ছে। রাস্তায় আধুনিক কেতার লাখে
লাখে গাড়ি। অ্যামবাসেডরের মতন কুলীন গাড়ি রাস্তায় দেখাই যায় না।
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জিনিসের বিজ্ঞাপনে রাস্তা-বাড়ি-মানুষ সবেরই মুখ
ঢেকে যায়। রাস্তায় চলছে পেল্লায় ও আধুনিক বাস। সারি সারি দামী জিনিসের
চকচকে দোকানের মাঝে দুখীমুখে উঁকি মারে পাড়ার মনোহারী দোকান, মুদির দোকান,
চুল কাটার সেলুন, ছিটকাপড়ের দোকান। অথচ রাস্তার ধারে ওপেন ড্রেন। শহরজুড়েই।
এই একবিংশ শতাব্দীর শাইনিং ইন্ডিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হাইটেক
শহরে। এবং নোংরাস্য নোংরা নিষ্কাশনী খাল। আর বিষজল-ভরা লেক। সে লেকও
দেখ-তো-দেখ ময়লা-টয়লা ঢেলে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তারপরেই নীল করোগেটেড শিট
দিয়ে বাউন্ডারি ও বিল্ডারের সাইনবোর্ড - লেকভিউ অ্যাপার্টমেন্ট। ভিউ লেকে
আছে ঠিকই - যদিও কদ্দিন থাকবে বলা যাচ্ছে না কারণ অন্য বিল্ডাররাও তো সেই
একই লেক বুজিয়েই লেকভিস্তা, ওয়াটারফ্রন্ট, অ্যাকোয়াভিউ প্রভৃতি হর্ম্যসমূহ
বানাইতেছে। আরও যেটা বলা নেই সে হল বিষ জলের দুর্গন্ধ ও ঝাঁকে ঝাঁকে
মশককুলের আগমন ও বসতিস্থাপন। জলধরবাবু বোঝেন খুব শিগ্গিরই ব্যাঙ্গালোরে আর
কোন ওয়াটার বডি থাকবে না। দূরদূরান্ত থেকে ট্যাংকারে জল আসবে। রাস্তাও উবে
যাবে। থাকবে শুধু থিকথিকে, দলা দলা বহুতল হর্ম্য, অট্টালিকা ও সারণী।
রাস্তায় মেঘ নয়, গাভীর মতন চরবে হেলিকপ্টার।<br />
<br />
শেষের ভয়ংকর সেদিনের কথা ভেবে জলধরবাবু শিউরে উঠলেন।<br />
<br />
[প্রথম প্রকাশ, ২৫-শে অক্টোবর, ২০১৩ <a href="http://www.guruchandali.com/blog/2013/10/25/1382657543822.html#.VTBPqpNtH08" target="_blank">গুরুচন্ডালী ডট কম</a>]</div>
</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-2667541151193273152015-04-16T17:09:00.000-07:002015-04-16T17:09:01.708-07:00সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মন - তৃতীয় পর্ব<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
<a href="http://atikathan.blogspot.com/2014/01/blog-post.html" target="_blank">[আগের অংশ]</a><br />
<br />
<div style="font-size: 12px;">
<br /></div>
আগেই বলেছি সলিলের আকর্ষণ সুরের জটিল বিন্যাসে। রাহুল সে তুলনায় অনেক
সহজপন্থী। "ফুলে গন্ধ নেই" কিংবা "পেয়ার দিওয়ানা হোতা হ্যায়" (বাংলা - গুণ
গুণ গুণ কুঞ্জে আমার) সহজ মেজর কর্ডের নোট প্যাটার্ন দিয়ে শুরু হয়। বলছি না যে রাহুলের
সব, এমনকি বহু সুরই, এমন সরল। কিন্তু সহজ গাণিতিক সুর করতে রাহুল পেছপা
হতেন না। সলিলও অনেক ক্ষেত্রে গাণিতিক - কিন্তু সে হায়ার ম্যাথেমেটিক্স।
গাণিতিক সুর বলতে কী বলতে চাইছি সেটা পরিস্কার করে দিই। যদি সুরের
ফ্রেজগুলো মূলতঃ চালু কর্ডের (মেজর, মাইনর ইত্যাদি) নোট ফলো করে, ফ্রেজগুলো
যদি চালু কর্ড প্রগ্রেশন মেনে ট্রানসপোজড হয়ে (এক, চার, পাঁচ - যেমন সি
মেজর, এফ মেজর, জি মেজর ইত্যাদি), তাহলে তাকে গাণিতিক সুর বলছি। সহজ
গাণিতিক সুরের চালু উদাহরণ - "ইন্দি-বিন্দি-সিন্দি"। সুরের এই চলন, বোঝাই
যায়, খুবই পশ্চিমি।<br />
<br />
সলিলের সুরের আরেক বৈশিষ্ট্য নোটেদের লাফালাফি। এই রয়েছে তার সপ্তকের
সা-তে, এই লাফ দিয়ে নেবে এল মধ্য সপ্তকের রে-তে। নীচু থেকে উঁচু নোটে লাফ
দিয়ে যাবার উদাহরণ তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য। উল্টোদিকের উদাহরণ, উঁচু থেকে
নীচে লাফ দিয়ে নাবা - সে বরং অনেক কম। রবীন্দ্রনাথে পাই, "যেতে যেতে একলা
পথে" গানে "ঝড়কে পেলেম সাথী" লাইনে সা-থী শব্দের সুরে। একেই চার-পাঁচ দিয়ে
গুণ করলে পাবেন সলিলের "ও ঝর ঝর ঝরণা, ও রূপালী বর্ণা" বা "ও বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়" ধরণের গান। লাফ দিয়ে চলা সুর
খুব পশ্চিমি ব্যাপার। অনেকদিন আগে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে দার্ঢ্য আনতে
শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন সুরের এই উল্লম্ফনকে।<br />
<br />
সলিল-রাহুল এই দুজনের সুরেই তাই পশ্চিমি ছায়া স্পষ্ট। দীর্ঘদিন আগে,
গণনাট্য সঙ্ঘ যুগে, ঠিক এই নিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে সলিল চৌধুরীর এক
বিখ্যাত তর্ক হয়েছিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন যে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্তালিনের বক্তব্য (মতান্তরে, পল রোবসনের)
"Nationalist in form" হতে হবে। এই গান যারা শুনবে,
শুনে উদ্বুদ্ধ হবে তারা<br />
মাটির কাছের মানুষ। তাদের কাছে দেশজ সুরের মাধ্যমে মেসেজ পৌঁছবে তাড়াতাড়ি।
গানের সুরের এই পশ্চিমি চলন তাঁর একেবারেই না-পসন্দ ছিল। সলিল চৌধুরীর
বক্তব্য ছিল যে তাঁরা যাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তারা ফর্মের দিক থেকে
অন্ত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে পড়েছেন। যেমন আধুনিক কামান-বন্দুকের মতন
যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে টাঙি-বল্লমের মতন দেশজ<br />
অস্ত্র দিয়ে লড়াই চালান যায় না, তেমনি গানের লড়াইও করতে হবে যেখানে যেরকম
আধুনিক উপায় আছে - সে সব ব্যবহার করে। পশ্চিমি চলনে বাঁধা গান সুন্দরবনের
প্রত্যন্তে মানুষ শুনছেন, উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।<br />
<br />
এই তর্কের মধ্যে রাজনীতির অংশ ছেড়ে দিলেও দেখব যে এই পশ্চিমি অনুপ্রেরণা,
পশ্চিমি চলন, পশ্চিমি নকলনবিশির ভূত তাড়া করে বেরিয়েছে সলিল-রাহুল -
দুজনকেই। অবস্থা এমনই হয়েছিল যে "সুরসিঙার" নামে একটি বিখ্যাত সংস্থার অতি
নামী পুরস্কার যখন রাহুল দেব বর্মন তাঁর "ও গঙ্গা মাইয়া" গানের জন্যে প্রায়
পেয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সংস্থার কর্ণধারদের মাথায় হাত পড়ে যায়। কেননা, ঐ
সংস্থা ও পুরস্কার ভারতীয় বনেদী সঙ্গীতের জন্যে উৎসর্গীত। রাহুল দেবের মতন
একজন পশ্চিমি লারেলাপ্পাপন্থী কী করে সেই পুরস্কার পেতে পারেন, সে তাঁর
একটি গান যতই ভাল হোক না কেন। এ তো গরহিত অপরাধ। সে যাত্রায় অব্শ্য ভারতীয়
সংস্কৃতির অতলস্পর্শী পতন শেষ মুহুর্ত্যে রক্ষা করা গিয়েছিল রাহুলের বদলে
অন্য এক সঙ্গীত পরিচালককে পুরস্কার দিয়ে।<br />
<br />
তো যা বলছিলাম - যেহেতু সলিলের সুরে জটিলতা, সলিলের প্রয়োজন ছিল অনুশীলিত
গলার।বম্বে যাবার পরে, এবং লতা মঙ্গেশকর নামের গান্ধর্বীর সঙ্গে কাজ শুরু
করার পরে সলিল হাত খুলে সুর করতে পারলেন। যদিও সলিল বহু আনট্রেন্ড গলার সঙ্গে কাজ
করেছেন। সলিল-হেমন্ত জুটি তো কিংবদন্তী। অবশ্য সলিল জনান্তিকে মন্তব্য
করেছেন হেমন্তর জন্যে নিজের বহু সুরকে সরল করতে হয়েছিল। এ বক্তব্যে হালকা
আক্ষেপ থাকলেও মনে রাখতে হবে হেমন্তর কন্ঠমাধুর্যের - গলার টিম্বারের - খুব
ভক্ত ছিলেন সলিল। বলেছিলেন ঈশ্বরের গান গাইতে ইচ্ছে হলে তিনি হেমন্তর গলায় গান করেন। এছাড়াও সময়ে সময়ে
চিত্রতারকা বিশ্বজিৎ থেকে তৎকালীন মাচার উঠতি জুটি
কার্তিককুমার-বসন্তকুমারকে দিয়ে গান করিয়েছেন সলিল। তা সত্বেও দেখছি জীবনের
প্রথম দিকে সলিলের গান গাইছেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, উৎপলা সেনরা। মৃণাল
চক্রবর্তীর লেখায় আক্ষেপ দেখি পয়সার জন্যে "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" মৃণাল
না পেয়ে পেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এ কথা যদি সত্যিও হয় (মিথ্যে ভাবার কোন
কারণ নেই), তাহলেও বলতে হয় সন্ধ্যার ট্রেনড ভয়েস গানটিকে যে উচ্চতায় নিয়ে
যায়, মৃণালের গলায় গানটা সে উচ্চতায় উঠত কিনা জানা নেই। যদিও মৃণালেরও
যথেষ্ট ট্রেন্ড গলা, কিন্তু সন্ধ্যার অনুশীলন সেখানে নেই।<br />
<br />
রাহুলের প্রয়োজন ছিল ভোকাল ক্যালিস্থেনিকসের। যা তিনি পেয়ে গেছিলেন
কিশোরকুমার আর আশা ভোঁশলের গলায়। এবং ষাটের দশকের মান্না দে-তে। এমনকি এও
শোনা যায় রাহুলের যুগান্তকারী "মেহবুবা মেহবুবা" গানটি আদতে মান্নাবাবুর
গাইবার কথা ছিল। মান্না দে-র বম্বেতে নাম ও পসার রাগগন্ধী ভারী গান গেয়ে।
রাহুল মান্নাকে দিয়ে যেমন "বুডঢা মিল গয়া" ছবিতে খাম্বাজে "আয়ো কহাঁসে
ঘনশ্যাম" গাইয়েছেন, তেমনি - বরং তার অনেক আগে মেহমুদের "ভূত-বাংলা"-র জন্যে
গাইয়েছেন "আও টুইস্ট করে" - যাতে মান্না দেখিয়েছিলেন ভোকাল ক্যালিস্থেনিক্সে তিনিও কম যান না। বোধহয় এই
ভোকাল ক্যালেস্থেনিক্সের কারসাজি না দেখাতে পারার কারণে রফি সাহেব রাহুলের
গানে বঞ্চিত<br />
হন জীবনের শেষের বছর দশেক। রাহুলের দলে যিনি গিটার বাজাতেন, ভূপিন্দর সিং
গাইয়ে হিসেবে শুধু আবির্ভূতই হন না, "বিতি না বিতায়ি"-র মতন গানে লতাবাঈয়ের
সঙ্গে প্রায় রফি-সম টক্কর দিয়ে যান। এর বাইরে রাহুলের সব রকম<br />
পুরুষকন্ঠের প্রয়োজনে কিশোরকুমার প্রায় ওয়াইল্ড কার্ডের - বা মাস্টারকার্ডের - মতন ব্যবহৃত হন। ফর এভরিথিং এলস দেয়ার ইজ কিশোরকুমার।</div>
Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-71702761003118609452014-01-26T00:45:00.000-08:002014-01-26T01:51:51.284-08:00সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মন - দ্বিতীয় পর্ব<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
<div class="separator" style="clear: both; text-align: left;">
<a href="http://atikathan.blogspot.com/2013/09/blog-post.html" target="_blank">[আগের অংশ]</a></div>
<br />
সলিল বা রাহুল কেউই খুব কড়া রাগভিত্তিক গান বানাতে পছন্দ করতেন বলে মনে
হয়না । তবে যেহেতু দুজনেই মূলতঃ ছবির জন্যে গান বানাতেন, বিভিন্ন সিচুয়েশনে
রাগনির্ভর গান বানাতে হয়েছে । এর বাইরে বেসিক গানে দুজনেই রাগ ব্যবহার
করেছেন খুবই নিয়ন্ত্রিতভাবে, এবং প্রায় সব সময়েই রাগরূপকে প্রকট না করে ।<br />
<br />
রাগ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সলিল কিন্তু রাগের চলন বা পকড় প্রতিষ্ঠা করে
দিতেন প্রথমেই। রাহুল আনতেন এক দু লাইন পরে। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। এমনকি
এমনও বলতে পারি যে ব্যতিক্রমের সংখ্যা এত বেশি যে আগের মন্তব্য হয়ত করা
ঠিকই নয়। তবু সেই মন্তব্যের স্বপক্ষে কয়েকটা উদাহরণ দিই।<br />
<br />
কলাবতী রাগকে ভিত্তি করে সলিল চৌধুরীর বেশ গুটিকয়েক গান আছে । এর মধ্যে
ধরা যাক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলায় "ঝনন ঝনন বাজে" গানটি । পঞ্চাশের দ্শকে
তৈরি গান। প্রথম লাইনেই কলাবতী পরিষ্কার। অন্তরাতে গিয়ে গানের চলন বদলে
যাচ্ছে।<br />
<br />
ঝনন ঝনন - <a href="http://www.youtube.com/watch?v=FfZqaQZH3sk"></a><br />
<div style="text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/FfZqaQZH3sk?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
আরেকটা কলাবতীভিত্তিক গান, "লাল পাথর" ছবিতে সবিতা চৌধুরী আর শ্যামল
মিত্রর যৌথ - "ডেকোনা মোরে ডেকোনা গো আর"। এখানেও প্রথম লাইন থেকেই রাগ
চিনতে অসুবিধে হয়না।<br />
<br />
ডেকোনা মোরে - <br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/8ugTrhF7BBk?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<br /></div>
<br />
<br />
অথচ এই কলাবতী (বা মিশ্র কলাবতী) রাগে রাহুলের গান - "বল কী আছে গো" নিজের
গলায়, যার হিন্দি গেয়েছিলেন মান্না দে ও লতা মঙ্গেসকর জুরমানা ছবিতে, "এ
সখী, রাখিকে"। কলাবতীর চলন প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু, গানের আভোগে নয়, অন্তরায়
গিয়ে - "চকিত চাহনী যেন দেখেও না দেখা"। আভোগ বা মুখড়ার দু-লাইনে রাহুল
রাগকে আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রাখেন।<br />
<br />
বল কী আছে গো - <br />
<div style="text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/mKcmkrvtr-A?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
এ সখী - <br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/W7xV9Ebw9Ug?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<br /></div>
<br />
এরকম আরেকটা উদাহরণ শিবরঞ্জনী রাগে। সলিল করলেন "ধরণীর পথে পথে আমিও পৌঁছে
যাব"। গাইলেন একবার সুবীর সেন, একবার লতা মঙ্গেশকর। প্রথম থেকে শিবরঞ্জনী
প্রতিষ্ঠিত। এবং সলিলের যা রীতি, অন্তরাতে গিয়ে রাগ গৌণ, সলিলের সুর মুখ্য
হয়ে পড়ল।<br />
<br />
ধরণীর পথে পথে - সুবীর সেন <br />
<br />
<div style="text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/s06EjPt3ZFk?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
রাহুল মিশ্র শিবরঞ্জনীতে করলেন "মেরে নয়না সাওন ভাদো" - মেহেবুবা ছবির
জন্যে কিশোরকুমার আর লতা মঙ্গেশকর আলাদা দুটি গান গাইলেন। এখানে পকড়ের ছবি
পাওয়া যাচ্ছে, পাশ্চাত্য রক-পপে যাকে গানের হুক বলে সেই অংশে, দ্বিতীয় "ফির
ভি মেরা মন পেয়াসা" উচ্চারণে। গানের প্রথমেই নয়।<br />
<br />
মেরে নয়না - কিশোরকুমার <br />
<br />
<div style="text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/8bcxc8Jrkuw?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
এবার উল্টোদিকে - শেষ জীবনে (১৯৯০ সালে) করা গান, নন্দ বা আনন্দী কল্যাণ
রাগে হৈমন্তী শুক্লা গাইলেন, "মন বন পাখী চন্দনা"। প্রথম লাইনের নন্দবাবুকে
চিনে নেওয়া গেল।<br />
<br />
<div style="text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/xoKzxrPjxWg?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
<br />
রাহুল মিশ্র নন্দ রাগে করলেন "যেতে দাও আমায় ডেকোনা"। এখানে বরং প্রথম লাইনে নন্দবাবুকে ধরা যায় কিছুটা।<br />
<br />
যেতে দাও আমায় - <br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/-W9A0wTtyCs?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<br /></div>
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<br /></div>
<br />
সলিল চৌধুরী করলেন অন্তরা চৌধুরীর জন্যে বেহাগ-আশ্রিত "না দির দির দা, তুম
না তুম, নাচ তো দেখি আমার পুতুলসোনা", প্রথম লাইন থেকে বেহাগ খুলে পড়া
যায়।<br />
<br />
না দির দির দা - <br />
<br />
<div style="text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/DUgo66aWPRo?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
যেমন যায় প্রায় একই সময়ে করা - সত্তরের দশকের প্রথম দিকে - "আপ কি কসম"
ছবির জন্যে রাহুলের সুরে কিশোরকুমারের "জিন্দেগীকে সফর মেঁ গুজর যাতে
হ্যায়" গানে।<br />
<br />
জিন্দগীকে সফর মেঁ - <br />
<br />
<div style="text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/nyZ6mv5y5mE?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
আগেই যে বললাম, খুব কড়া রাগভিত্তিক গান তৈরি করতে কি সলিল, কি রাহুল, কেউই
পছন্দ করতেন না। কিন্তু ছবির সিচুয়েশন অনেক সময়ই রাগভিত্তিক গানে চেয়েছে।
সেরকম ক্ষেত্রে এনারা রাগের পরিসীমার মধ্যে থেকেই যতটা সম্ভব নিজেদের
সাঙ্গীতিক উদ্ভাবনী দেখিয়েছেন। এমনই একটি গান - সলিলের বিখ্যাত হংসধ্বনী,
"যা তোসে নহি বলুঁ কানহাইয়া"। একদম রাগদারী গান, প্রথম লাইন থেকেই।<br />
<br />
<br />
<div style="text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/cYzClpA387w?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
এ গানেরই বাংলা করলেন শেষ জীবনে, গাওয়ালেন হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে -<br />
<br />
<div style="text-align: center;">
<object class="BLOGGER-youtube-video" classid="clsid:D27CDB6E-AE6D-11cf-96B8-444553540000" codebase="http://download.macromedia.com/pub/shockwave/cabs/flash/swflash.cab#version=6,0,40,0" data-thumbnail-src="https://ytimg.googleusercontent.com/vi/_4a4CCTYnfc/0.jpg" height="266" width="320"><param name="movie" value="https://youtube.googleapis.com/v/_4a4CCTYnfc&source=uds" /><param name="bgcolor" value="#FFFFFF" /><param name="allowFullScreen" value="true" /><embed width="320" height="266" src="https://youtube.googleapis.com/v/_4a4CCTYnfc&source=uds" type="application/x-shockwave-flash" allowfullscreen="true"></embed></object></div>
<br />
রাহুল এমতাবস্থায় বহুবার বাবার খজানায় হাত বাড়িয়েছেন - যেমন কিনারা ছবিতে
"মিঠে বোলে বোলে" শচীনের বিখ্যাত বাংলা ভৈরবী "মধুবৃন্দাবনে দোলে রাধা"-কে
ফিরিয়ে আনে।<br />
<br />
মিঠে বোলে বোলে - <br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/xvEhz4szccI?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
<br />
মধুবৃন্দাবনে - <br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/SIo0Gl3PuJ8?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
<br />
অথবা ইজাজত ছবির "খালি হাত শাম আয়ি হ্যায়" গানে ফিরিয়ে আনলেন কর্তার "মালাখানি ছিল হাতে" গানের বন্দিশ।<br />
<br />
খালি হাত - <br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/xFBQm-wSwcE?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
<br />
মালাখানি - <br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/GL6QbppeyfU?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
<br />
অথচ এমনটা নয় যে বাবার খজানা ছাড়া এই ধরণের সিচুয়েশনে রাহুলের কোনরকম
অসুবিধে হত। অমর প্রেম ছবিতে "রহনা বীত যায়" কি "কুছ তো লোগ কহেঙ্গে" অথবা
"বড়া নটখট হ্যায় ইয়ে" গানেই তার প্রমাণ। অথবা পরিচয় ছবির "বিতি না বিতায়ি
রহনা"।<br />
<br />
বিতি না বিতায়ি - <br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/WUV7SDwjxik?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
<br />
"বড়া নটখট" সম্বন্ধে গল্প চলে যে সাধাসিধেভাবে রাগের চালু বন্দিশে ফেলে
কাজ সারতে চেয়েছিলেন রাহুল। বাবা বর্মন নাকি ছেলে বর্মনকে কড়কানি দেন এই
বলে যে, এই গানে তুমি কী যোগ করলে? যে কোন সঙ্গীত পরিচালকই তো রাগে ফেলে এই
গান বানাতে পারে। এই ধাঁতানির পরে শোনা যায় রাহুল গানটিকে খাম্বাজে রেখে
নতুন করে সাজান। শেষ পর্যন্ত যে গানটি দাঁড়ায় সেটি এই -<br />
<br />
বড়া নটখট - <br />
<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;">
<iframe allowfullscreen='allowfullscreen' webkitallowfullscreen='webkitallowfullscreen' mozallowfullscreen='mozallowfullscreen' width='320' height='266' src='https://www.youtube.com/embed/8uhPePg1oNQ?feature=player_embedded' frameborder='0'></iframe></div>
<br />
<div style="font-size: 12px;">
(চলবে)
</div>
</div>
Unknownnoreply@blogger.com1tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-26770706646322831122013-09-04T12:49:00.001-07:002014-01-26T00:37:44.090-08:00সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মন<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
<div dir="ltr" style="text-align: left;" trbidi="on">
সলিল চৌধুরী আর রাহুল দেব বর্মন - মেলোডির দুই রাজা । দুজনেই কমার্শিয়াল গানের জগতে নিজেদের পেশাদার জীবন গড়ে তুলেছিলেন । অথচ সঙ্গীতের অপ্রোচে দুজনে দু পথের পথিক । সলিল চৌধুরীর আকর্ষণ জটিল সঙ্গীতিক নির্মাণে, অন্যদিকে রাহুল দেব বর্মন সুরের সহজ চলনে বিশ্বাসী । অ্যারেঞ্জমেন্টে সলিল প্রথম জীবনে ধ্রুপদী - বিশেষতঃ পশ্চিমী আঙ্গিকে, শেষের জীবনে তৎকলীন পশ্চিমী রক-পপ ঘরানার অনুসারী । রাহুল প্রথম থেকেই নিজের মতন পাঁচমিশেলি আঙ্গিক তৈরি করে নিয়েছেন । সলিল চৌধুরী যেখানে ঘন স্ট্রিংস আর বাঁশির বুনিয়াদে সঙ্গীতের প্রাসাদ গড়ছেন, রাহুল দেব বর্মনের সাঙ্গীতিক ইমারত সেখানে পার্কাশান আর গিটার ভিত্তিক ।<br />
<br />
কিন্তু সলিল ও রাহুল দুজনেরই কিন্তু সাঙ্গীতিক রসদের ভাঁড়ার লোকসঙ্গীত । দুজনের সঙ্গীতের মূল কিন্তু সেখানেই । তার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকেই মিশেছে পশ্চিমি সঙ্গীতের শ্রবণাভ্যাস । সলিলের ক্ষেত্রে পশ্চিমি ধ্রূপদী সঙ্গীত, রাহুলের ক্ষেত্রে জ্যাজ, পপ ও পরে রক । তার মানে এ অবশ্যই নয় যে দুজনেই সব ধরণের গানে অসামান্য জ্ঞানভান্ডার গড়ে তোলেন নি । সুমন চট্টোপধ্যায়ের লেখায় জানতে পারি নিউ ইয়র্কের কোন এক জ্যাজ ক্লাবে এক জ্যাজ সঙ্গীতকারকে সলিল জ্যাজের কর্ড প্রোগ্রেশন নিয়ে এমন ফান্ডা দিয়েছিলেন যে সেই সঙ্গীতকার স্বীকার করেন এমন ফান্ডাবাজ সঙ্গীতজ্ঞ তিনি আর দেখেননি ।<br />
<br />
যদি ধরে নিই যে সঙ্গীতনির্মাণ কোন গভীর মনোবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যেখানে চেতনের থেকে অবচেতনের প্রভাব বেশি - তাহলে অবশ্যই সঙ্গীতের বাইরে আর কী কী এলিমেন্ট এই দুই ধুরন্ধর সঙ্গীত ব্যক্তিত্বর বেড়ে-ওঠা-সময়ে জীবনে প্রভাব ফেলেছিল সেটা জানা এনাদের সঙ্গীত বিশ্লেষনে প্রয়োজন হবে। অথচ এই দিকে গালগল্প যত চলে, ঠিকঠাক তথ্যের চালান তত নেই । সলিল চৌধুরীর তাও অর্ধ-সমাপ্ত একটি আত্মজীবনী আছে, রাহুলের তো তাও নেই । <br />
<br />
এনাদের গানের একটা তুলনামূলক আলোচনা শুরু করার একটা ভাল জায়গা হল এনাদের এমন কোন গান বেছে নেওয়া যেখানে কোথাও একটা সাধারণ সূত্র আছে । সেরকম একটা গান হল সলিলের "পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী" আর রাহুলের "তুম মেরি জিন্দগীমে কুছ এইসি তরাহ সে আয়ে"। দুটি সুরই একই সুর থেকে অনুপ্রাণিত । <br />
<br />
প্রথমে শুনুন সলিলের "পল্লবিনী" । গানের প্রিলিউড থেকেই অ্যাকোর্ডিয়ান আর বঙ্গোর সঙ্গত গানের উচ্ছল মেজাজ তৈরি করে দেয় ।<br />
<br />
<center>
<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="315" src="http://www.youtube.com/embed/HQaitde3dyY" width="420"></iframe></center>
<br />
<br />
রাহুল তাঁর গানটি ব্যবহার করলেন "বম্বে টু গোয়া" ছবির জন্যে । গানের শুরু হচ্ছে লতার হাল্কা হামিং দিয়ে । তৈরি করছে - যাকে বলে - "সফট রোমান্টিক" মেজাজ । (যে রেকর্ডিং শুনছেন, তার প্রথম গিটার লীড পরে যোগ করা ।)<br />
<br />
<center>
<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="315" src="http://www.youtube.com/embed/s3gGoYM5b2A" width="420"></iframe></center>
<br />
<br />
<br />
প্রথম থেকেই গান দুটির মেজাজের তফাত স্পষ্ট । খুব তৈরি কান ছাড়া মিল খুঁজে পাওয়া দুরূহ । কিন্তু মূল সুর শুনলে মিল পরিষ্কার হয়ে যাবে । (একবার মূল সুরের সঙ্গে 'পল্লবিনী' গুনগুন করুন, দ্বিতীয়বার 'তুম মেরে' গুনগুন করুন । দুবারই খাপে খাপ মিলে যাবে ।) মূল সুরটি চার্লি চ্যাপলিনের লাইমলাইট ছবিতে ব্যবহার করা হয়, সম্ভবত: চ্যাপলিনের নিজের কম্পোজিশন । এবার শুনুন মূল সুরটি - <br />
<br />
<div style="text-align: left;">
</div>
<div style="text-align: left;">
</div>
<div style="text-align: left;">
</div>
<div style="text-align: left;">
</div>
<div style="text-align: center;">
<br />
<iframe allowfullscreen="" frameborder="0" height="315" src="http://www.youtube.com/embed/3S_9wiT67gs" width="420"></iframe></div>
</div>
<br />
মুক্তছন্দের মূল সুরকে সলিল ফেললেন ৪/৪ ছন্দে, ষোলমাত্রায় । রাহুল ফেললেন
৩/৪ ছন্দে পশ্চিমি ওয়াল্টজের চলন - যা গানটির সফট রোমান্টিক মেজাজ আনতে
সাহায্য করছে । সুরকারদের এটা একটা প্রচলিত কায়দা - মূলের সুর মোটামুটি এক
রেখে তাল-লয় বদলে গানের অবয়ব বদলে দেওয়া। আপাতভাবে সলিল সুরের বেশি
কাছাকাছি মনে হবে। যদিও হয়তো তা নয়। সলিল বিদেশী পিসের প্রথম অংশকেই নিজের
গানের প্রথম লাইনে ব্যবহার করেছেন। রাহুল ডালপালা ছেঁটে সেই সুরই ব্যবহার
করলেন। এটও লক্ষ্যণীয় যে, সুরের চলনে যেটুকু বিদেশী গন্ধ আছে, যেমন কিছু
অ্যাক্সিডেন্টাল নোটসের ব্যবহার, সেগুলো সলিল-রাহুল দুজনেই পরিহার করলেন।<br />
<br />
আসলে এই দুই সুরকারই যখনই যেখানে নেবার মতন কোন মিউজিকাল এলিমেন্ট
পেয়েছেন, তা সচ্ছন্দে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু নির্বিচারে নয়। নিজেদের মতন
গড়ে-পিঠে নিয়ে ব্যবহার করেছেন। রাহুলের ক্ষেত্রে অভিযোগ যে বহু বিদেশি সুর
তিনি "চুরি" করেছেন। এ অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু বহু
ক্ষেত্রেই রাহুল প্রথম কয়েকটি বারের বেশি নেননি। এবং যে অংশ নিয়েছেন তাকেও
নিজের মতন বদলে নিয়েছেন। সলিলও যখন মোৎজার্টের সিম্ফনির সুর ব্যবহার করছেন,
তখনও কিন্ত ২/৪ কে পাঁচমাত্রা ফেলে এবং লয়ের পরিবর্তন করে অন্য রূপ দেবার
চেষ্টা করছেন।<br />
<br />
(চলবে)
</div>
Unknownnoreply@blogger.com2tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-4773401640312649852010-07-24T20:58:00.000-07:002010-07-25T12:16:02.489-07:00আধুনিক এন আর আইদের করুণ উপাখ্যানএই উপাখ্যানের নাম হতে পারত "অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়" অথবা "মডার্ন এন আর আই মে ভারত কিঁউ ছোড়া"। খুলেই বলি।<br />
<br />
সে অনেকদিন আগে, জানেন, যখন আমি ইশকুল-টিশকুলে পড়তাম সেই সময় ছিল এন আর আইদের স্বর্ণযুগ। তখন তো আর এখনকার মতন পাড়ায় পাড়ায় এন আর আইয়ের চাষ হতনা। পাড়ায় এক পিস এন আর আই থাকলে পাড়ার ঘ্যামই বেড়ে যেত। শীতকালে এন আর আই পরিবার আসতেন, পাড়ার লোক কলার তুলে ঘুরে বেড়াত। অন্যপাড়ায় গিয়ে রেলা নিয়ে আসত। এন আর আই পরিবারের কর্তা জিনস পরে থলি হাতে বাজারে গিয়ে মহার্ঘ্য চিংড়িমাছ কিনতেন। এন আর আই গিন্নি টকটকে লিপস্টিক মেখে পার্ক স্ট্রীটের দোকান থেকে হাজার-দুহাজারের শাড়ি কিনে ননদ-ভাজদের ওয়ার্ল্ড ডর্ফে চীনে খাওয়াতেন। এন আর আই বাচ্চারা মিকিমাউস আঁকা জামা পরে ফুরফুরে ইংরিজিতে কথা বলত। সে এক দিন ছিল। কাছের লোকেরা বিকের ডট পেন পেত, আরও কাছের লোকেরা শার্ট প্যান্ট আর একদম নিজের প্রাণের লোকেদের জন্যে ঘড়ি ক্যামেরা। বাকিদের জন্যে লরির পেছনের আপ্তবাক্য "বুরি নজরওয়ালে তেরাহ মুহ কালা'। যে লোক দেশে থাকতে কোনদিন কথা বলেনি, সেই গায়ে পড়ে, "কি রে ভোম্বল কেমন আছিস? একদিন আসিস না, তোর জ্যাঠাইমা তো তোর কথা প্রায়ই বলে" বলে খেজুর করত। যে মেয়ে জীবনে কোনদিন পাত্তা দেয়নি, নাক ঘুরিয়ে চলে যেত, সেও বাপের বাড়ি এসে "ওমা ভোম্বলদা, কত ফর্সা হয়ে গেছ" বলে খুচরো বিলকিছিলকি ফ্লার্ট করত। ভোম্বলদা রোদ্দুরের দিকে মুখ করিয়ে পোলারয়েড ক্যামেরায় আত্মীয়-স্বজনের ছবি তুলতেন। তিরিশ গোনার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার তলা নিয়ে সড়াত্ করে ছবি বেরিয়ে আসত। পাড়ার লোক অবাক হয়ে চেয়ে দেখত। চালু হত নতুন নাগরিক প্রবাদের। উফ, সে এক উজ্জ্বল সোনালী দিন ছিল এন আর আইদের।<br />
<br />
আমরা গল্প শুনতাম। আর ভাবতাম। স্কুলে যখন রচনা লিখতে দিত "তুমি বড় হয়ে কি হবে", লিখতাম বড় হয়ে হয়ে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক হব, বিনিপয়সায় গরীবঘরের ছেলেমেয়েদের পড়াব। দেশ গড়ব। মনে মনে ভাবতাম এন আর আই হব।<br />
<br />
তারপরে একদিন এন আর আই হলাম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। টিউশনির টাকায় জিআরই-টোয়েফল, বাবার টাকায় ৩৫ ডলার করে অ্যাডমিশন ফি। হো চি মিন সরণিতে লাইন। ধার করে সস্তার প্লেনের টিকিট। দু-বছরের কৃছস্রাধন। চাকরি। ধারশোধ। গাড়িকেনা। আবার ধার। চক্রবত্ পরিবর্তন্তে দুখানি চ। একখানি চ হল চক্রবৃদ্ধিহারে ধার। অন্যখানি চ - চাকরি যাবার চিন্তা।<br />
<br />
এন আর আই হয়ে কি দেখিলাম সেলুকাস? সেলুকাস জবাব দিল, "তোমার দিন গিয়াছে এন আর আই। নিজভূমে পরবাসী হইয়া ঘ্যাম লইতে গিয়াছিলে। এখন তোমার একূল-ওকূল দুকূলই গেল। ওদিকে পরভূমে নিজবাসী হইবার চক্কর অতি প্যাঁচালো। গ্রীন কার্ডের লাইন এখন দীর্ঘ পাঁচবছর লম্বা। অ্যাপ্লিকেশানে হেয়ার লিখিয়াছিলে 'ব্ল্যাক'। গ্রীন কার্ড যদি কখনও হস্তগত হয়, হেয়ারের স্থানে লিখিতে হইবে "নান'। এই তো লাইফ।"<br />
<br />
ওদিকে বাত্সরিক ফাঁট দেখানোর খরচ সাত-আট হাজার টাকা। চারজনের প্লেনের টিকিটই পাঁচ। বাকি টাকায় ওখানে ফাঁটও তেমন দেখানো যায় না। দেখাব কি মশাই, ওয়ালমার্টে কেনা র্যাংলার জিন্স পরে বাজার করতে গিয়ে দেখি মাছওলা ব্যানানা রিপাব্লিক পরে মাছ বেচছে। তার শালা এন আর আই। দাগাটা সামলে দরদাম করতে গিয়ে হ্যাটা হলাম। পাশ দিয়ে হাঁটুর বয়েসি সেকটর ফাইভ স্যান্ট্রো চালিয়ে এসে এসে দই খেয়ে চলে গেল। হাতে রইল থলি।<br />
<br />
বাকি যে দুর্গ ছিল, ফান্ডা, তাতেও মৌরসী পাট্টা নাই। বন্ধুকে ওবামা সম্পর্কে নিজের অন্তর্দৃষ্টির হকিকত্ বাতলাতে গিয়ে বন্ধুর বন্ধুর থেকে শুনে এলাম ওবামা, অ্যামেরিকান ইলেকশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স সহজে পাবার উপায়, নর্থ ডাকোটার আবহাওয়া, রোড আইল্যান্ডের পাবলিক ট্র্যাসপোর্টেশন থেকে কেজান কুইজিনের নাড়িনক্ষত্র। তিনি অ্যামেরিকা বিশেষজ্ঞ। তিনমাস ছিলেন। ওক্লাহোমায়। খাপ খোলার কোনরকম চান্সই নেই। তার ওপর পাঁচমিনিট আগেই তিনি ভিড় চৌরঙ্গিতে এমনি এমনি চারবার এপার ওপার করে সাইকোলজিকাল ওয়্যারফেয়ারের পয়লা রাউন্ড হ্যান্ডস-ডাউন জিতেছেন। আমি তখন গাড়ির স্রোতে ভ্যাবাচ্যাকা। অলরেডি দুবার মুটের "এই খবর্দা-আ-র' খেয়েছি। আবার বেশি ট্যাঁফোঁ করলে ভিড় প্রাইভেট বাসে উঠে আমাকে সাইকোলজিকালি একেবারে নিষ্পেষিত করে দেবেন বলে ভয় দেখিয়ে রেখেছেন।<br />
<br />
কি বলব দাদা, এই এন আর আই জীবনে ঘেন্না ধরে গেল। দাও ফিরে সেই অরণ্য, লও এ নগর। এখন সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের রচনা লিখতে শেখাই, "হোয়েন আই গ্রো আপ, আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক টু মাই পেরেন্টস কান্টি ইন্ডিয়া অ্যান্ড বিকাম এন ইন্ডিয়ান"। <br />
<br />
[২০শে এপ্রিল, ২০০৮ <a href="http://guruchandali.com">guruchandali.com</a>]Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-40677265047078530252010-06-14T22:22:00.000-07:002010-06-17T09:38:30.955-07:00মোগলাই সাহেবসুবোবেশ কয়েকবার বইটা শেল্ফে দেখেছি । এয়ারপোর্টের বইয়ের দোকানে, ব্যাঙ্গালোরের বইয়ের দোকানে, পাড়ার লাইব্রেরিতে, অফিসের লাইব্রেরিতে । একবার ব্লার্বে novel কথাটা চোখে পড়ায়, উল্টেপাল্টে দেখার ইচ্ছে হয়নি । অত মোটা ইংরিজি প্রেমের উপন্যাস পড়ার আকর্ষণ আমার কোনদিনই ছিল না । শেষ পর্যন্ত, অফিসের লাইব্রেরিতে পড়ার মতন কোন বই না পেয়ে একরকম বাধ্য হয়েই নিয়েছিলাম White Mughals । লেখক, William Dalrymple । মোটকা বই । পরে দেখেছি শেষের Glossary, Bibliography, Index বাদ দিয়ে উপাখ্যান শেষ হয় ৫০১ পাতায় ।<br /><br />উপন্যাস নয় । ইতিহাস । অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের ক'বছর থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ক'বছর হল মূল কাহিনীর সময়সীমা । তবে খেইয়ের সুতো শুরু হয়েছে তার অনেক আগে, শেষ হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে । ইতিহাসের নায়ক জেমস কার্কপ্যাট্রিক । হায়দ্রাবাদে নিজমের দরবারের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট । নায়িকা হায়দ্রাবাদের অভিজাত পরিবারের ইরাণী বংশোদ্ভুত মেয়ে খয়েরউন্নিসা । এদের প্রেমকে ঘিরে যে ইতিহাসের জাল বুনেছেন তাতে কে নেই ! আছেন নিজাম ও তার প্রধানমন্ত্রী; হায়দ্রাবাদের ইরাণী বংশোদ্ভুত অভিজাত পরিবার; লর্ড কর্নওয়ালিস, জন শোর, লর্ড ওয়েলেসলি; মারাঠা পেশোয়া; টিপু সুলতান ...<br /><br />অসম্ভব পরিশ্রমের কাজ । দীর্ঘ অধ্যবসায়ে বিভিন্ন মহাফেজখানা ঘুরে, লন্ডন-দিল্লি-হায়দ্রাবাদ ঘুরে খুঁটে খুঁটে সংগ্রহ করা তথ্য জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে গল্পের যে গালিচা বুনেছেন তার তুল্য ইতিহাস আমি অন্ততঃ পড়িনি । আর লেখার এমনই গুণ, চরিত্র আর ঘটনাগুলো চোখে দেখা যায় । এই "চোখে দেখা যায়" শব্দবন্ধটি এত ব্যবহৃত হয় যে এ দিয়ে আর ঠিক মনের ভাব প্রকাশ করা যায়না বটে, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনভাবে অনুভবটা ঠিক প্রকাশ করা যেত না । চোখে দেখানো ছাড়াও যে আবহ (উর্দুতে কী যেন বলে, মাহোল? সংস্কৃতে বাতাবরণ? বাংলায়?) তৈরী করেছেন, সেটা কোন ঐতিহাসিক নয়, ঔপন্যাসিকের উপযুক্ত কাজ । কেয়াবাত !!Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-64946191568739007622009-02-11T09:22:00.001-08:002010-06-17T20:16:01.141-07:00Unicode, Unicodeইউনিকোডে লেখার প্রচেষ্টা করছি | যদি পাঠকের মেশিনে কোন ইউনিকোড ফন্ট বসানো থাকে, তাহলে এই লেখা বাংলায় দেখতে না পাবার কোন কারণ নেই | তবে অক্ষরের ছাঁদ কিরকম হবে, সেটা নির্ভর করছে পাঠকের মেশিনে কোন ইউনিকোড ফন্ট বসানো আছে তার ওপর | যদি একাধিক ইউনিকোড ফন্ট থাকে, তাহলে দেখতে হবে ডিফল্ট ইউনিকোড ফন্ট কোনটা | মাইক্রোসফট বৃন্দা নামের একটা ইউনিকোড ফন্ট ডিফল্ট হিসেবে দেয় | বেশ বাজে দেখতে | এনকোডিং-এও কিছু গড়বড় আছে মনে হয় | এককভাবে খন্ড-ত (ৎ) লেখা যায়না | বাংলার সবথেকে পপুলার ইউনিকোড ফন্ট সোলেইমানলিপিতেও একই অসুবিধে লক্ষ্য করছি | আর একটু ঘাটাঘাঁটি করতে হবে | তবে ফ্রি-স্যান্স, ফ্রি-সেরিফ কি একুশে দুর্গা বা ব্যাঞ্জন রূপালী ইত্যাদি ফন্টে সেই সমস্যা নেই | আশা করছি, দিন কয়েকের মধ্যে এ ব্যাপারে আরও কিছু ফান্ডা করতে পারব | <a href="http://bongolipi.org" title="Bongolipi Project" target="_blank">বঙ্গলিপি</a>র ইউনিকোড সাপোর্ট ইমপ্লিমেন্ট করতে গিয়ে প্রচুর শেখা হচ্ছে |Unknownnoreply@blogger.com2tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-32439274471620382572009-02-02T05:36:00.001-08:002010-06-17T20:16:01.207-07:00BonGoLipiFinally released <a href="http://bongolipi.prg" title="Bongolipi.org" target="_blank">Bongolipi</a>.<br/><p align="center"><img src="https://sourceforge.net/dbimage.php?id=203053" alt="Bongolipi thumbnail" align="middle" height="250" width="400" /></p>Unknownnoreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-4785902181701457648.post-73706859896436597332008-05-25T09:20:00.001-07:002010-06-17T22:49:20.335-07:00তিন পাহাড়ের গানবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা প্রথম পড়ি বোধহয় যখন আমি স্কুলে কি কলেজে পড়ি । অল্প বয়েসের কাঁচা মনে খুবই দাগ কেটেছিল । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোনদিন ডাকসাইটে কবি ছিলেন না । জীবনানন্দ, বিষ্ঞু দে অথবা শক্তি-সুনীলের সঙ্গে একসঙ্গে কখনই ওনার নাম বলা হত না । অথচ ওরকম একক ও বলিষ্ঠ স্বর আমি বোধহয় আর কারও কবিতায় পাইনি । ঐ একই সময়ে স্কুল অফ পীপলস আর্টের একটা ক্যাসেট হাতে আসে । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পাঠ আর সুর দিয়ে গান । সুর করেছিলেন বিনয় চক্রবর্তী । অসামান্য কাজ । কবিতার বই আর এই ক্যাসেট - দুয়ে মিলে বীরেন চাটুজ্জে আমার মধ্যে জেঁকে বসছিলেন ।<br />
<center><br />
<object height="355" width="425"></object><br />
<embed height="355" src="about:blank" type="application/x-shockwave-flash" width="425" wmode="transparent"></embed><br />
</center><br />
খুব ভাল লেগেছিল 'তিন পাহাড়ের গান' কবিতাটা । "<i>পাহাড়িয়া মধুপুর মেঠো ধূলিপথ / দিনশেষে বৈকালী মিষ্টি শপথ</i>" । অসম্ভব প্রাণবন্ত চিত্রকল্প । এসময়ে আমি নিজেও টুকটাক সুর-টুর করতে আরম্ভ করেছি । তো এই "তিন পাহাড়ের গান"-এও সুর করি এই সময়ে । পুরোটা নয় । কবিতাটা আরও লম্বা । কিন্তু যেখানে মনে হয়েছিল গান শেষ হওয়া উচিত, সেই অব্দিই সুর করেছিলাম । সেটা বোধহয় ১৯৮৮-৮৯ সাল । নিজের জন্যে করা, নিজের কাছেই রাখা ছিল । কাউকে শোনানো হয়নি । তার প্রায় বছর বারো-চোদ্দ পরে পারমিতার উৎসাহে ও প্ররোচনায় একে ওকে শোনাই । তারও পরে, ২০০৭ সালে এসে অ্যারেঞ্জ করি গানটা । এই সেই গান ।Unknownnoreply@blogger.com0