বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

সলিল চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মন - তৃতীয় পর্ব

[আগের অংশ]


আগেই বলেছি সলিলের আকর্ষণ সুরের জটিল বিন্যাসে। রাহুল সে তুলনায় অনেক সহজপন্থী। "ফুলে গন্ধ নেই" কিংবা "পেয়ার দিওয়ানা হোতা হ্যায়" (বাংলা - গুণ গুণ গুণ কুঞ্জে আমার) সহজ মেজর কর্ডের নোট প্যাটার্ন দিয়ে শুরু হয়। বলছি না যে রাহুলের সব, এমনকি বহু সুরই, এমন সরল। কিন্তু সহজ গাণিতিক সুর করতে রাহুল পেছপা হতেন না। সলিলও অনেক ক্ষেত্রে গাণিতিক - কিন্তু সে হায়ার ম্যাথেমেটিক্স। গাণিতিক সুর বলতে কী বলতে চাইছি সেটা পরিস্কার করে দিই। যদি সুরের ফ্রেজগুলো মূলতঃ চালু কর্ডের (মেজর, মাইনর ইত্যাদি) নোট ফলো করে, ফ্রেজগুলো যদি চালু কর্ড প্রগ্রেশন মেনে ট্রানসপোজড হয়ে (এক, চার, পাঁচ - যেমন সি মেজর, এফ মেজর, জি মেজর ইত্যাদি), তাহলে তাকে গাণিতিক সুর বলছি। সহজ গাণিতিক সুরের চালু উদাহরণ - "ইন্দি-বিন্দি-সিন্দি"। সুরের এই চলন, বোঝাই যায়, খুবই পশ্চিমি।

সলিলের সুরের আরেক বৈশিষ্ট্য নোটেদের লাফালাফি। এই রয়েছে তার সপ্তকের সা-তে, এই লাফ দিয়ে নেবে এল মধ্য সপ্তকের রে-তে। নীচু থেকে উঁচু নোটে লাফ দিয়ে যাবার উদাহরণ তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য। উল্টোদিকের উদাহরণ, উঁচু থেকে নীচে লাফ দিয়ে নাবা - সে বরং অনেক কম। রবীন্দ্রনাথে পাই, "যেতে যেতে একলা পথে" গানে "ঝড়কে পেলেম সাথী" লাইনে সা-থী শব্দের সুরে। একেই চার-পাঁচ দিয়ে গুণ করলে পাবেন সলিলের "ও ঝর ঝর ঝরণা, ও রূপালী বর্ণা" বা "ও বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়" ধরণের গান। লাফ দিয়ে চলা সুর খুব পশ্চিমি ব্যাপার। অনেকদিন আগে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে দার্ঢ্য আনতে শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন সুরের এই উল্লম্ফনকে।

সলিল-রাহুল এই দুজনের সুরেই তাই পশ্চিমি ছায়া স্পষ্ট। দীর্ঘদিন আগে, গণনাট্য সঙ্ঘ যুগে, ঠিক এই নিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে সলিল চৌধুরীর এক বিখ্যাত তর্ক হয়েছিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন যে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্তালিনের বক্তব্য (মতান্তরে, পল রোবসনের) "Nationalist in form" হতে হবে। এই গান যারা শুনবে, শুনে উদ্বুদ্ধ হবে তারা
মাটির কাছের মানুষ। তাদের কাছে দেশজ সুরের মাধ্যমে মেসেজ পৌঁছবে তাড়াতাড়ি। গানের সুরের এই পশ্চিমি চলন তাঁর একেবারেই না-পসন্দ ছিল। সলিল চৌধুরীর বক্তব্য ছিল যে তাঁরা যাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তারা ফর্মের দিক থেকে অন্ত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে পড়েছেন। যেমন আধুনিক কামান-বন্দুকের মতন যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে টাঙি-বল্লমের মতন দেশজ
অস্ত্র দিয়ে লড়াই চালান যায় না, তেমনি গানের লড়াইও করতে হবে যেখানে যেরকম আধুনিক উপায় আছে - সে সব ব্যবহার করে। পশ্চিমি চলনে বাঁধা গান সুন্দরবনের প্রত্যন্তে মানুষ শুনছেন, উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

এই তর্কের মধ্যে রাজনীতির অংশ ছেড়ে দিলেও দেখব যে এই পশ্চিমি অনুপ্রেরণা, পশ্চিমি চলন, পশ্চিমি নকলনবিশির ভূত তাড়া করে বেরিয়েছে সলিল-রাহুল - দুজনকেই। অবস্থা এমনই হয়েছিল যে "সুরসিঙার" নামে একটি বিখ্যাত সংস্থার অতি নামী পুরস্কার যখন রাহুল দেব বর্মন তাঁর "ও গঙ্গা মাইয়া" গানের জন্যে প্রায় পেয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সংস্থার কর্ণধারদের মাথায় হাত পড়ে যায়। কেননা, ঐ সংস্থা ও পুরস্কার ভারতীয় বনেদী সঙ্গীতের জন্যে উৎসর্গীত। রাহুল দেবের মতন একজন পশ্চিমি লারেলাপ্পাপন্থী কী করে সেই পুরস্কার পেতে পারেন, সে তাঁর একটি গান যতই ভাল হোক না কেন। এ তো গরহিত অপরাধ। সে যাত্রায় অব্শ্য ভারতীয় সংস্কৃতির অতলস্পর্শী পতন শেষ মুহুর্ত্যে রক্ষা করা গিয়েছিল রাহুলের বদলে অন্য এক সঙ্গীত পরিচালককে পুরস্কার দিয়ে।

তো যা বলছিলাম - যেহেতু সলিলের সুরে জটিলতা, সলিলের প্রয়োজন ছিল অনুশীলিত গলার।বম্বে যাবার পরে, এবং লতা মঙ্গেশকর নামের গান্ধর্বীর সঙ্গে কাজ শুরু করার পরে সলিল হাত খুলে সুর করতে পারলেন। যদিও সলিল বহু আনট্রেন্ড গলার সঙ্গে কাজ করেছেন। সলিল-হেমন্ত জুটি তো কিংবদন্তী। অবশ্য সলিল জনান্তিকে মন্তব্য করেছেন হেমন্তর জন্যে নিজের বহু সুরকে সরল করতে হয়েছিল। এ বক্তব্যে হালকা আক্ষেপ থাকলেও মনে রাখতে হবে হেমন্তর কন্ঠমাধুর্যের - গলার টিম্বারের - খুব ভক্ত ছিলেন সলিল। বলেছিলেন ঈশ্বরের গান গাইতে ইচ্ছে হলে তিনি হেমন্তর গলায় গান করেন। এছাড়াও সময়ে সময়ে চিত্রতারকা বিশ্বজিৎ থেকে তৎকালীন মাচার উঠতি জুটি কার্তিককুমার-বসন্তকুমারকে দিয়ে গান করিয়েছেন সলিল। তা সত্বেও দেখছি জীবনের প্রথম দিকে সলিলের গান গাইছেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, উৎপলা সেনরা। মৃণাল চক্রবর্তীর লেখায় আক্ষেপ দেখি পয়সার জন্যে "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" মৃণাল না পেয়ে পেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এ কথা যদি সত্যিও হয় (মিথ্যে ভাবার কোন কারণ নেই), তাহলেও বলতে হয় সন্ধ্যার ট্রেনড ভয়েস গানটিকে যে উচ্চতায় নিয়ে যায়, মৃণালের গলায় গানটা সে উচ্চতায় উঠত কিনা জানা নেই। যদিও মৃণালেরও যথেষ্ট ট্রেন্ড গলা, কিন্তু সন্ধ্যার অনুশীলন সেখানে নেই।

রাহুলের প্রয়োজন ছিল ভোকাল ক্যালিস্থেনিকসের। যা তিনি পেয়ে গেছিলেন কিশোরকুমার আর আশা ভোঁশলের গলায়। এবং ষাটের দশকের মান্না দে-তে। এমনকি এও শোনা যায় রাহুলের যুগান্তকারী "মেহবুবা মেহবুবা" গানটি আদতে মান্নাবাবুর গাইবার কথা ছিল। মান্না দে-র বম্বেতে নাম ও পসার রাগগন্ধী ভারী গান গেয়ে। রাহুল মান্নাকে দিয়ে যেমন "বুডঢা মিল গয়া" ছবিতে খাম্বাজে "আয়ো কহাঁসে ঘনশ্যাম" গাইয়েছেন, তেমনি - বরং তার অনেক আগে মেহমুদের "ভূত-বাংলা"-র জন্যে গাইয়েছেন "আও টুইস্ট করে" - যাতে মান্না দেখিয়েছিলেন ভোকাল ক্যালিস্থেনিক্সে তিনিও কম যান না। বোধহয় এই ভোকাল ক্যালেস্থেনিক্সের কারসাজি না দেখাতে পারার কারণে রফি সাহেব রাহুলের গানে বঞ্চিত
হন জীবনের শেষের বছর দশেক। রাহুলের দলে যিনি গিটার বাজাতেন, ভূপিন্দর সিং গাইয়ে হিসেবে শুধু আবির্ভূতই হন না, "বিতি না বিতায়ি"-র মতন গানে লতাবাঈয়ের সঙ্গে প্রায় রফি-সম টক্কর দিয়ে যান। এর বাইরে রাহুলের সব রকম
পুরুষকন্ঠের প্রয়োজনে কিশোরকুমার প্রায় ওয়াইল্ড কার্ডের - বা মাস্টারকার্ডের - মতন ব্যবহৃত হন। ফর এভরিথিং এলস দেয়ার ইজ কিশোরকুমার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন